পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
175

সাথে এলএমজি ছিল। বাঙ্কারের ছিদ্র দিয়ে ব্রাস্ট এসে তারা মাথা সম্পূর্ণ উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করে। আমি বেঁচে যাই।

 সেদিন পাকবাহিনী কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। বেলা ২টার দিকে ওরা ওখানেই পাকা বাঙ্কার করতে শুরু করে। বাঙ্কার করতে গেলেই আমরা গুলি শুরু করতাম। ওরা বাঙ্কার বন্ধ রাখতো। এ সময় প্রায়ই মুষল ধারে বৃষ্টি হতো। আমরা বৃষ্টির মধ্যেই যুদ্ধ করে যেতাম। একই জামা ভিজতো আবার শুকাতো। ৫০০ গজের মধ্যে পাকবাহিনী এবং আমরা সামনাসামনি ১৫/২০ দিন যুদ্ধ করি। ছোট খাট দুটো দেশের সামনাসামনি যুদ্ধ বলা যেতে পারে। পাকবাহিনী পাকা বাঙ্কার করে আমাদের উপর দিনে রাতে অন্যান্য দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে আক্রমণ চালায় কিন্তু সমস্ত জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনী ছিল। সবরকমের চেষ্টা করেও আমাদের ডিফেন্স ওরা ভাঙতে পারেনি।

 পাকসেনা এবং আমরা সামনাসামনি থাকি। তখন পুরো বর্ষা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুই দেখা যায় না। পাকসেনারা এ অবস্থার সুযোগ নেয়। তারা দুটি নদী দিয়ে ৬/৭টি গানবোটে সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। পর পর চারটি হেলিকপ্টারযোগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ থেকে ৮টার সময় আমাদের পিছনে সৈন্য নামিয়ে দেয়। সামনে তো পাকসেনা ছিলোই। আমরা বিপদে পড়লাম। কারণ আমাদের গানপয়েণ্ট ফেনীর দিকে। সামনে, পিছনে, পাশে এবং গানবোট সব ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা মেসেজ পেলাম পিছু হটবার জন্য। কারণ এখানে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে চলে আসি। আর যারা ছিল তারাও চলে আসে। আমার সংবাদ যারা সবশেষে পায় তারা আসার পথে পাকিস্তানীদের গুলিতে আমার বাহিনীর ৪/৫ জন আহত হয়, তবে কেউ মারা যায়নি। আমরা সবাই একত্রিত হয়ে পুনরায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করি। ঠিক এ সময়ই আমাদের উপর হুকুম হয় সিগনালস টিম গঠন করার জন্য। কারণ, আসলে আমি সিগনালের মানুষ। আমি চলে আসি আগরতলাতে। ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে আমি সিগনাল কোর গঠন করতে থাকি। সিগনালের অভাবেই অধিকাংশ যুদ্ধ ময়দানে আমরা মার খাচ্ছিলাম। পরদিন যুদ্ধ করবার জন্য পুরো ব্রিগেডের জন্য সিগনাল টিম গঠন করি। 'কে' ফোর্স, ‘এস' ফোর্স এবং “জেড' ফোর্স' নামে তিনটি ব্রিগেড গঠিত হয়। 'কে ফোর্স এবং 'এস ফোর্সের জন্য, সেই সঙ্গে 'জেড' ফোর্সের জন্যও লোকজন সংগ্রহ করা হয়। ফ্লাইং অফিসার রউফ থাকেন এস ফোর্সের সাথে। আমি থাকি 'কে' ফোর্সের সাথে। আক্রমণ চালাই একযোগে।ফেনী মুক্ত করে ফেলি। পরবর্তীকালে ১০ম বেঙ্গলে আবার অস্ত্র ধরি সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসেবে। ক্রমশঃ অগ্রসর হতে থাকি। তারপর একের পর এক দখল করে চলি। চট্টগ্রমের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। পুরো ব্রিগেড নিয়ে চলিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় অনেক কোম্পানী ছিল। আমরা ফৌজদারহাট পর্যন্ত যাই- তখন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমরা ওখানেই থেকে যাই। টিবি হাসপাতালের ২০ মাইলের মধ্যে চট্টগ্রাম। ওখানে পাকবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী তার ব্যাপক বাহিনী হারায়।

 আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি। পাকবাহিনী গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে, লুট করেছে, নারী ধ্বংস করেছে। গ্রামগুলোতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

স্বাক্ষরঃ শহীদুল ইসলাম
২৩-৩-৭৩

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হুমায়ন কবির[১]

 ১৭ই মে আমাকে প্রথম অপারেশনে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন গফফার সাহেবই আর নেতৃত্ব দেন। কসবা, কুটিবাড়ি, আড়াইবাড়ি ইত্যাদি এলাকায় পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিল। আমরা লোক দিয়ে সমস্ত অবস্থান জেনে নিয়ে


  1. বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে ১৯৭৩ সালে এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।