পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
180

ফায়ারিং-এর শব্দ শুনে চিতলিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটির শত্রুরা মনে করলো তাদের ট্রলিটা হয়তো বা কোন মুক্তিবাহিনীর গেরিলার দলের হাতে পড়েছে। প্রকৃত অবস্থাটা তারা কিন্তু তখনও বুঝতে পারেনি। তখন দু'দিক থেকেই শত্রুরা আক্রমণ শুরু করলো।

 এদিকে এয়ার আহমদ আনন্দে বাঙ্কার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল অদূরে পড়ে থাকা শত্রুদের মৃত অফিসারটির কাছে। গোলাগুলির কথা সে যেন মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল। অফিসারের পকেট থেকে সে পিস্তলটি উঠিয়ে নিল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে আসতে লাগলো নিজ বাঙ্কারের দিকে। ঠিক তক্ষুণি শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে একটি বুলেট এসে বিধলো এয়ার আহমেদের মাথায়। চোখের সামনেই দেখতে পেলাম ওর শরীরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। ঢলে পড়লো বাঙ্কারের মুখে। রক্তে ঢেকে গেল ওর জয়ের আনন্দে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠা মুখটা। নিজের জান দিয়ে এয়ার আহমদ শত্রুদের ঘায়েল করেছে। কিন্তু এর শেষ দেখে যাওয়া তার কপালে সইলো না।

 ৯ই নভেম্বর। সেদিন ওকে হারিয়ে বেদনায় মূহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। একজন বীরকে হারিয়ে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম ঠিকই তবুও কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এয়ার আহমেদের রক্তের বদলা নেবার জন্য শত্রুদের হামলার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়ে চললাম, শত্রুর আক্রমণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে চললাম। শত্রুরা সারাদিন ধরে আমাদের বিভিন্ন পজিশনের উপর তুমুলভাবে আক্রমণ চালালো।

 সারাদিন কেটে গেল। বৃষ্টির মত আর্টিলারী আর শেলিং-এর শব্দে আশেপাশের নীরব এলাকা কেঁপে উঠতে লাগলো। ক্রমে রাত হয়ে এলো। অন্ধকার রাত। শত্রুরা এবার পরশুরাম ঘাঁটি থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলো। আমাদের জোয়ানরা তার পাল্টা জবাব দিয়ে চললো। পরশুরাম থেকে এ আক্রমণের আকার ছিল অতি ভয়ংকর। ওরা এমনভাবে আমাদের জালে আটকা পড়েছে যে, বের হবার কোন পথই নেই। ওরা বুঝতে পারলো এটা ওদের জীবন-মরণ সমস্যা। তাই তারা প্রাণপণে লড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ওদেরকে আমাদের জাল ছেড়ে বের হতে দিলাম না। আমরা তাদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিতে লাগলাম।

 শত্রুদের বেলুনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটিতে যারা ছিল তারা শুধু সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। যে করেই হোক ওরা চিতলিয়া থেকে সাহায্য ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলো- কিন্তু আমরা তা ব্যর্থ করে দিলাম। ওদের এই প্রাণপণ লড়াইয়ের জবাব দিয়ে আমরা শত্রুদের পরশুরাম আক্রমণ প্রতিহত করি।

 তারপর ভোর হলো। ওরা আমাদের উপর অনবরত শেলিং ও ফায়ারিং করতে লাগলো। আমরা উচিত জবাব দিয়ে চললাম।

 সেদিন বেলা ৪ টার সময় হঠাৎ শত্রুরা আমাদের উপর বিমান হামলা শুরু করলো। কিন্তু ওরা এতে আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারলো না। এবার আমরা আরো সতর্কতা অবলম্বন করলাম।

 সেদিন গেল। তার পরের দিনও আগের দিনের মতই ফায়ারিং ও শেলিং চললো। দুপক্ষ থেকেই সমানে আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চললো। ওদের শুধু একটিই উদ্দেশ্য, হয় চিতালিয়ার সাথে যোগাযোগ না হয় পালানো। কিন্তু সে মুহূর্তে পালানো ছাড়া তাদের আর কোন পথ আসলেই ছিল না। শুধু ফায়ারিং ও শেলিং-এর শব্দে মাঝে মাঝে সে এলাকার প্রকৃতি আর গাছপালা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল, অনেক সময় এক মিনিটও বিরাম ছিল না। শব্দের জন্য অতি কাছের লোকেরা কথাও শোনা যেত না।

 সেদিন বেলা ৩-৫০ মিনিট। হঠাৎ দেখলাম তিনটা শত্রু বিমান আমাদের এলাকায় উড়ে আসছে। এসেই ওরা সে এলাকার উপর বোম্বিং করতে শুরু করলো। অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে যেতে লাগলো। চারিদিকে দাউ দাউ করে বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে। ওরা বেশ নিচু হয়েই বোম্বিং করছিল। যদিও আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বহু ছিল কিন্তু বিমান বিধ্বংসী কামান আমাদের ছিল না। আমরা তাই শেষরক্ষা হিসেবে এমএমজিকে এ কাজে ব্যবহার