পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
189

উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় আমার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। শুধু আমার বাহিনীকে কমাণ্ড করতে লাগলাম। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। ছাত্রদলের একমাত্র কমাণ্ডার সফি ও অন্যান্য কয়েকজন ব্যতীত সবাই সরে পড়লো। এ সময় আমি, ছাত্রদলের সফি এবং আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কর্মী আব্দুর রব চন্দ্রগঞ্জ বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখছিলাম! হঠাৎ শত্রুবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য আমাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। আমরা পিছনে সরি। তখন এল-এম-জি টার্গেট আমাদের দিকে। ছাত্রনেতা সফির হাত থেকে এল-এম-জি'টা নিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ একটা ব্রাশ মারলাম। ব্যাপারটা ঘটে গেল খুবই দ্রুত। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠলো পাকবাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটতে লাগল পাকবাহিনীর বুলেট। এ সময় আমার হাতের এল- এম-জি ম্যাগাজিনশূন্য। মৃত্যু অবধারিত ভাবলাম। কিন্তু এমন সময় আমাদের জোয়ানরা শত্রুদের উপর পিছন থেকে আক্রমণ করে, ফলে শত্রুরা ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। এমন সময়ে আমরা ক্রলিং করে পলায়ন করি। এভাবে আমরা মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাই।

 ৪ঠা ডিসেম্বর: ইঞ্জিনিয়ার নায়েক আবুল হোসেন-এর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দিলাম যে তারা যেন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলগুলি ধ্বংস করে দেয়। তাদের সাহায্যের জন্য প্রত্যেক জায়গায় এ্যামবুশ পার্টি পাঠানো হলো। রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলগুলি ধ্বংস করা হলে পাকবাহিনী খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং কুমিল্লার দিকে পালাতে থাকে। পলায়ন পর পাকসেনাদের সঙ্গে জায়গায় জায়গায় এ্যামবুশরত মুক্তিবাহিনীর খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়।

 ৫ই ডিসেম্বর: হাবিলদার আব্দুল লতিফকে এক প্লাটুন মুক্তিফৌজ দিয়ে লাকসাম-নোয়াখালী সড়কে শত্রুদের পলায়ন রোধ করার জন্য পাঠাই। কিন্তু তিনি ফিরে এসে জানালেন যে, আক্রমণের ভয়ে পাকবাহিনী রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে পলায়ন করেছে।

 ৬ই ডিসেম্বর: হাবিলদার আব্দুল মতিন খবর পাঠালেন যে লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরে তুমুল যুদ্ধের পর ১০৮ জন রাজাকারকে নিহত করে লক্ষ্মীপুর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করা হয়েছে এবং রায়পুরও মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তাধীন। এ খবর পাবার পর আমার জোয়ানদের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে যায়।

 ৭ই ডিসেম্বর: এইদিন নোয়াখালীর রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা। সকলের মুখে শ্লোগান আর শ্লোগান। হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। নতুন সূর্যের উদয় হলো নোয়াখালীতে।

 ৩রা ডিসেম্বরের প্রোগ্রাম অনুযায়ী ভোর ছ'টায় আমরা আক্রমণ করলাম সোনাইমুড়ি। রাজাকারদের সাথে গুলি বিনিময় হচ্ছে। এদিকে হাজার হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছে। অবশেষে ৬৩ জন রাজাকারকে নিহত করে সোনাইমুড়ি দখল করা হলো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে বীর যোদ্ধা হাবিলদার নূর মোহাম্মদ এবং ছাত্রনেতা সালেহ আহমদ এ যুদ্ধে শহীদ হন। সোনাইমুড়ি মুক্ত হবার পর আমরা বজরা আক্রমণ করি এবং বজরা মুক্ত করে চৌমুহনী অভিমুখে রওনা হই। এখানেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চৌমুহনী আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পর বহু রাজাকার নিহত হয় এবং অবশিষ্ট রাজাকার আমাদের হাতে বন্দী হয়। চৌমুহনীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। এসময় নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা ও শামসুল হক এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং চৌমুহনী আক্রমণে সাহায্য করেন। এ সময় মেজর জাফর ইমাম চৌমুহনীতে তাঁর বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন এবং পরে যৌথ শক্তিতে মাইজদী আক্রমণ করে তা মুক্ত করা হয়।

 এ যুদ্ধে আহত হয়ে আজও নায়েক সুবেদার ইসহাক ও হাবিলদার জালাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়। আমাদের এ যুদ্ধে জনসাধারণ যথেষ্ট সাহায্য করেন, বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে