পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
197

ডিসেম্বরের ৪/৫ তারিখে। সে সময় পাকিস্তানীরা ফেনী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কারণ পাকিস্তানীদের পিছনের সঙ্গে সকল যোগাযোগ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গেরিলারা সে সময় পাকিস্তানীদের খুব নাজেহাল করছিল। ৫ই ডিসেম্বরের ভোরে তারা রাতারাতি চলে যায় লাকসামের দিকে। ভোরবেলা আমরা দেখলাম পাকিস্তানী ডিফেন্স শূন্য। এর আগে আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি গিয়েছিল। তারা ফেরার পথে পরিখায় অবস্থানরত রাজাকারদের পাকড়াও করে। তারা এখনও জানতো না যে পাকিস্তানী আর্মি ভেগে গেছে। ফেনীর মূলত সেদিনই পতন ঘটে। সেদিন সত্যিই আমাদের আনন্দের দিন ছিল। আমার মনে সব সময় একটা ইচ্ছা ছিল যে, মৃত্যুর আগে যেন অন্তত বাংলাদেশের একটি শহর মুক্ত-স্বাধীন দেখে যেতে পারি।

এরপর আমাদের নোয়াখালীর আনাচে-কানাচে যেতে হয় পাকিস্তানী সেনার কিছু অবস্থানকে মুক্ত করতে। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল এই যে, চৌমুহনী ও মাইজদী কোর্টে রাজাকারদের রেজিসটেন্স। রাজাকারদের দুর্ভেদ্য ব্যুহ নাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাইতেও ভাল ছিল। রাজাকারদের বড় বড় নেতারা এবং কিছু হাফ ফোর্স চৌমুহনী ও মাইজদী কোর্টের দালান-কোঠায় উঠে পজিশন নিয়ে আমাদের বেশ ক্ষতি সাধন করে। তারা সহজে সারেণ্ডার করেনি। শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে বল প্রয়োগ করে সারেণ্ডার করাতে হয়। এরপর আমাদের ব্যাটালিয়ান ‘মুভ’ করে চিটাগাং এর দিকে। চিটাগাং-এর দিকে আমরা এ্যাডভান্স করি ৯ই ডিসেম্বর থেকে।

চিটাগাং-এর দিকে যখন আমরা এ্যাডভান্স করি তখন সীতাকুণ্ডে পকিস্তানীরা আমাদের প্রতিরোধ করে।

১০ তারিখে আমরা সীতাকুণ্ডে পৌঁছাই। এরপর যখন আমরা কুমীরার কাছাকাছি আসলাম তখন আমাদের ব্যাটালিয়নকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটা অংশ আমাদের সিওর নেতৃত্বে তিন কোম্পানীসহ পাহাড়ের উপর দিয়ে চিটাগাং ইউনিভার্সিটির দিকে যায়। সেখানে বহু পাকিস্তানী সেনা আত্মসমর্পণ করে। আমাকে রাখা হলো ইণ্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে ঢাকা-চিটাগাং ট্রাংক রোড-এ। ভারতীয় দুটো ব্যাটালিয়ন-এর সঙ্গে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হয়। একটা হলো কুমীরায়। সেখানে দু'দিন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। তৃতীয় দিন আমরা রাতে ডান ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে ঢুকে পড়ি। এই গ্রুপে শুধু মুক্তিবাহিনী ছিল, অর্থাৎ আমার কোম্পানীই ছিল। আর ছিল ১নং সেক্টরের একটি কোম্পানী। আমরা পাকিস্তানী ডান ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে যখন চলে আসি, তখন তাদের সঙ্গে আমাদের প্রচুর গোলাগুলি হয়। এতে আমাদের বেশ হতাহত হয়। সে সময় পাকিস্তানীরা কুমীরা ছেড়ে পিছু হটতে শুরু করে এবং আমরা পাকব্যূহে ঢুকে পড়ি। এই সময় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী ভুলবশত আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে। আমাদের ব্যাটালিয়ন তখন খাকি ড্রেস পরতো। ভারতীয়রা মনে করেছিল পাকিস্তানী সৈন্য, আর তাই তারা গোলাবর্ষণ করেছিল। যাই হোক তারা তাড়াতাড়ি শুধরে নেয়। কারণ একজন ইণ্ডিয়ান ওপি ছিলেন যাকে আমি চিনতাম। তিনি আমাকে এবং আমার লোককে চিনতে পেরেছিলেন। ফলে তেমন কোন ক্ষতি আমাদের হয়নি। দু-একটা গোলা পড়েছিল কিন্তু কোন হতাহত হয়নি। তবে হতাহত হতে পারতো যদি সেই ভারতীয় অফিসার আমাদের না চিনতেন। কুমীরার পরের রেজিস্টেন্সটা হয় এখন যেখানে তার এক মাইল উত্তরের। সেখানে ১৬ই ডিসেম্বর বিকালে যখন সারেণ্ডার আরম্ভ হয়েছে- পাকিস্তান আর্মির দুইজন অফিসার সর্বপ্রথম আমার ডিফেন্সে-এ এসে সারেণ্ডার করে। তখন আমি ইণ্ডিয়ান আর্মিকে খবর দেই। কমাণ্ডিং অফিসার এবং একজন বিগ্রেডিয়ার আসেন। আত্মসমর্পণকারী দু'জন পাকিস্তানী অফিসারের একজন হচ্ছেন গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ইফতেখার আর একজন লেঃ ছিলেন তার নামটা আমি ভুলে গেছি। উনি বোধ হয় ৪৬ ই-এমএর। ১৭ই ডিসেম্বর যখন ইণ্ডিয়ান আর্মি ‘মুভ’ করলো চিটাগাং শহরে, তখন ইণ্ডিয়ান আর্মি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমাদেরকে ঢুকতে দেবে না; আমরা পরে ঢুকবো। ইণ্ডিয়ান ৩২ মাহারের সি-ও ছিলেন লেঃ কর্নেল হরদেব সিং। যেহেতু আমি তার সঙ্গে ছিলাম, তিনি বিগ্রেড