পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
200

কখনো ফিরে আসেনি। যেহেতু সিলেটে প্রথম দিকে গেরিলা তৎপরতা কম ছিল, সেহেতু পাকিস্তানী সৈন্যরা সিলেটে এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারতো।

 একেবারেই যে সাহায্য পায়নি সেটা বললেও ভুল হবে। কিছুসংখ্যক লোক আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে এবং যারা সাহায্য করেছে তারা মনেপ্রাণে সাহায্য করেছে, তাই জুলাই মাসের পর থেকে সিলেট জেলার ভেতরে গেরিলা বেইস তৈরী করার জন্য আমরা সাহায্য নেই। তারপর থেকে গেরিলা তৎপরতা কিছুটা প্রকাশ পায়।

 আমাদের নিকট অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুব অল্প। বন্ধুরাষ্ট্র থেকেও কখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই যেসব যুবককেই আমরা ভিতরের বেইস-এ কাজ করার জন্য পাঠাতাম তাদেরকে ১০ জনের একটা ব্যাচ করে তাদের হাতে দুটো কি তিনটা হাতিয়ার, একটা করে গ্রেনেড এবং কিছু পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে পাঠাতাম। এইসব অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার আমার নির্দেশ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী গণবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনীর সম্বন্বয়ে, যৌথ পরিকল্পনা ও পরামর্শে, নিয়মিত বাহিনীর কমাণ্ডারের নেতৃত্বে ব্যবহৃত হত।

 আগস্ট মাস হতে বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আমরা বেশ কিছুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র পাই। তখন আমরা দশজনের দলের মধ্যে আটজনকে অস্ত্র দিতে পেরেছিলাম। তারপর থেকেই গেরিলা তৎপরতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভীষণভাবে জোরদার হয়ে ওঠে। তখন থেকেই পাকিস্তানীদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাফেরার নিরাপত্তা যথেষ্টভাবে বিঘ্নিত হয়।

 অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত আমরা যেভাবে গেরিলাদের ভেতরে ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়েছি, তাতে এমন কোন বাড়ি বাদ ছিল না যেখানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা ছিল না।

 আমি যে এলাকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছি সে এলাকাতে প্রায় ২৫/৩০ হাজার গেরিলা নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত কাজ করছিল। যে অস্ত্র তাদের দিয়েছিলাম সে অস্ত্র ছাড়াও পাকবাহিনী রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং পুলিশ স্টেশন থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যা বিশেষভাবে বেড়ে যায় এবং ছেলেদের মনোবলও সাথে সাথে বেড়ে যায়।

 এমন কতগুলো জায়গা ছিল, সেগুলো পাকবাহিনী কখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি, যেমন- রায়পুরা, শিবপুরের উত্তরাংশ, মনোহরদী, কাপাসিয়া, বাজিতপুর, কুলিয়াচর, ভালুকা, গফরগাঁও এই সমস্ত এলাকায় আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থাও ছিল।

 যেহেতু আমরা যুবকদের ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভেতরে পাঠাচ্ছিলাম এবং আমাদের কনভেনশনাল যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেহেতু মনতলা থেকে সিংগারবিল পর্যন্ত এলাকায় কনভেনশনাল পদ্ধতিতে প্রতিরক্ষা ব্যূহে তৈরী করি-কিন্তু নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের দ্বারা গেরিলা অপারেশন-এর জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়ক পাকবাহিনীর জন্য এক মরণফাঁদ ছিল।

 তাই পাক-বাহিনী আমাদেরকে এ জায়গা থেকে সরাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমরাও আমাদের ঘাঁটিকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করি। কারণ এটাই ছিল আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়ের স্থল। এ জায়গা যদি আমরা হারাই তাহলে আমাদের ভারতে আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। যদিও তখন আমাদের সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্প এবং হেডকোয়ার্টারের কিয়দংশ ছিল ভারতে।

 এই ক্ষুদ্র জায়গাটুকু রক্ষা করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু পাকবাহিনীও আমাদের পিছু হটাবার জন্য বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। কারণ আমাদের হটিয়ে দিতে না পারলে সিলেট হাইওয়ে তাদের জন্য নিরাপদ