পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
203

সুবেদ আলী ভূঁইয়া), ৮। কালাছড়া-লেঃ মজুমদার, ৯। কলকলিয়া, ১০। বামুটিয়া (এ দুটি সাবসেক্টরে কমাণ্ডার ছিলেন লেঃ মোরশেদ এবং লেঃ সাঈদ)

 এই সেক্টরগুলিতে কনভেনশনাল যুদ্ধ ছাড়া তারা গেরিলা যুদ্ধও চালাত। যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বেইস-এ গেরিলাদের পাঠাবার দায়িত্বও এই সমস্ত সাবসেক্টর কমাণ্ডারদের উপর ন্যস্ত ছিল। সাবসেক্টর কমাণ্ডাররা সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে পাঠিয়ে দিত। গেরিলাদের পাঠাবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও সাবসেক্টর কমাণ্ডারদের দায়িত্ব ছিল। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কখনো তাদেরকে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধেও লিপ্ত হতে হয়েছিল।

 আমাদের প্রধান সেনাপতির নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা আমাদের কর্মতৎপরতা জোরদার করি। প্রধান সেনাপতির নির্দেশের পূর্ব থেকেই আমরা বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য বেইস নির্মাণ শুরু করছিলাম। কিন্তু তার এই নির্দেশ মোতাবেক এ বেইসগুলোকে আরও সুসংহত করি। যাতে এক সেক্টরের গেরিলার সাথে অন্য সেক্টরের গেরিলাদের সংঘর্ষ না ঘটে সেজন্য আমাদের বেইসগুলোকে এমনভাবে তৈরী করি যেন বর্ডারিং বেইসগুলো একে অন্যের সাথে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হতে পারে।

 সেপ্টেম্বরের (১৯৭১) প্রথম দিক থেকে ডিসেম্বরের (১৯৭১) মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের গেরিলা তৎপরতা এমনভাবে বেড়ে যায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বাংলাদেশের ভিতরে ছিল না বললেই চলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভিতরে নিম্নলিখিত গেরিলা অপারেশনগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-

রায়পুরার নিকটবর্তী বেলাবো অপারেশন- ১৪ই জুলাইঃ

 পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখনো রায়পুরা, নরসিংদী, কাপাসিয়া, মনোহরদী, কুলিয়াচর, কটিয়াদী এলাকায় ১৪ই জুলাই পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। কারণ আমাদের নিয়মিত বাহিনী দ্বারা গঠিত এই ক্যাম্পগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। তাদের এসব জায়গা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য পাকবাহিনী লঞ্চের সাহায্যে বেলাবো অভিমুখে অগ্রসর হয়। বেলাবোতে আমার যে দল ছিল তার নেতৃত্ব করছিল সুবেদার বাশার। সে বেলাবোর নিকটবর্তী এলাকা টোকের কাছে তার লোকজন দ্বারা এক এ্যামবুশ তৈরী করে। দুর্ভাগ্যবশত সুবেদার বাশারের এ এ্যামবুশের খবর পাকবাহিনী নিশ্চয়ই কোন বিশ্বাসঘাতকের সহযোগিতায় জানতে পারি। তাই পাকিস্তানী সৈনিকরা যে মটর লঞ্চে করে আসছিল তার মধ্যে থেকে কিছুসংখ্যক পাকসৈনিক সর্বাগ্রে নৌকা করে আসে এবং নৌকার বেশ কিছু পেছনেই আসছিল একখানা খালি লঞ্চ। যেহেতু সুবেদার বাশার এবং তার সাথীরা বসেছিল লঞ্চের অপেক্ষায়, নৌকা করে যেসব পাকসেনা সর্বপ্রথম অগ্রসর হয়েছিল তা তারা টের পায়নি। এবং যেইমাত্র খালি লঞ্চ তাদের সামনে আসে তারা সে লঞ্চের উপর গোলাগুলি করে। তাদের এ গোলাগুলির সাথে সাথে পাক-বাহিনীর অগ্রগামী এবং পেছন থেকে অগ্রসরমান সৈনিকরা এ দলটিকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমাদের সাহসী সৈনিকগণ শত্রুর হাতে অস্ত্র সমর্পণ না করে বীরবিক্রমে লড়তে থাকে। এ লড়াই কয়েক ঘণ্টা অব্যাহত থাকে। অবশেষে কিছুসংখ্যক সৈনিক পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। যারা এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন- ১। সুবেদার আবুল বাশার, ২। সিপাহী আবদুল বারী, ৩। সিপাহী নুরুল ওহাব, ৪। সিপাহী সোহরাব হোসেন, ৫। সিপাহী মমতাজ উদ্দীন, ৬। সিপাহী আবদুল হক, ৭। সিপাহী আবদুস সালাম।

 সুবেদার বাশারের মৃতদেহ হলদী ক্ষেতের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়, দেখা যায় তাঁর পেটের ক্ষতস্থানটি তাঁর নিজের শার্ট দিয়ে বাঁধা। এলএমজি মৃতদেটের পাশেই ছিল। মূল্যবান কাগজপত্র মৃত্যুর আগে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তিনি পাশে ফেলে রাখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সুবেদার বাশার এবং তাঁর সঙ্গীদের অবদান ভুলবার নয়। বেলাবোর জনগণ এখনো তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গীদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।