পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
210

 এই হেডকোয়ার্টার যখন ইসলামপুরের নিকট পৌঁছে তখন পেছন থেকে একখানা ট্রাক আসতে দেখা যায়। ট্রাকখানা যে রঙ্গের ছিল সে রকম একখানা গাড়ী ১১ইস্ট বেঙ্গলেরও ছিল। ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার গাড়ীখানা দূর থেকে দেখে আমাকে বলে “স্যার তেলিয়াপাড়া নিশ্চয়ই আমাদের হস্তগত হয়েছে এবং আমার গাড়ীও চলে আসছে।” এখানে বলে রাখা দরকার যে, গাড়ী একমাত্র তেলিয়াপাড়া হয়ে আসতে পারত। আমাদের গাড়ী ছাড়া অন্য কোন গাড়ী আসতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস ছিল না। কেননা চান্দুরা এবং মাধবপুরের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের রোড ব্লক ছিল, যার কমাণ্ডার ছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া। গাড়ী আমাদের কাছে আসতেই ড্রাইভারকে ইশারা দিয়ে আসতে বলা হয় এবং গাড়ী থেমে যায়। আশ্চর্যের বিষয় যে গাড়ীটা আমাদের ছিল না। সে গাড়ীতে পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই ছিল। তারা তেলিয়াপাড়া থেকে পশ্চাদপসরণ করে 'আসছিল। গাড়িতে পাকিস্তানী সৈন্য দেখে তাদেরকে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দেই। দু' চারজন অস্ত্র রেখে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায় এবং তার মধ্যে থেকে দুই একজন বোধ হয় আমাদের সংখ্যা কম দেখে গোলাগুলি শুরু করে এবং গাড়ির চারিদিকে লাফিয়ে পড়ে। গাড়ীর সামনের সিটে বসা ছিল একজন সুবেদার। সেও গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। বাকী সৈন্যরা গাড়ী থেকে নেমে রাস্তার অপর পাশে চলে যায়। এসব সৈনিকদের অধিকাংশই ছিল পাঠান এবং মিলিশিয়া পোশাক পরিহিত।

 আমরা ইসলামপুরের যে স্থানে ছিলাম সেখানে থেকে এক হাজার গজ দূরে শাহাবাজপুরের দিকে ছিল এক কোম্পানী সৈন্য। এবং আমাদের প্রায় মাইলখানেক পিছনে পাইকপাড়া থেকে ক্রস কানট্রি হয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসরমান বাকী সৈন্য। গাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে এবং পেছনে আমাদের লোক অস্ত্র উঠিয়ে ছিল। গাড়ীর উত্তর পাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামের দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখান থেকে গোলাগুলি ছোড়ে। সুবেদার সামনের সিটে দক্ষিণ পার্শ্বে বসা ছিল। সে গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। সুবেদারের কাছে ছিল পিস্তল। আমার কাছেও ছিল পিস্তল। দুইজনেরই পিস্তল ছিল 'পাউচ'-এর মধ্যে। আমার এসএমজিটা আমার রানারের কাছে। রানার ছিল আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। সুবেদার এবং আমার মাঝে ধস্তাধস্তি প্রচণ্ড। কেউ কারোর পিস্তল বের করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ইতিমধ্যে আমার রানার কয়েকবার সুবেদারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে চেয়েছিল। হঠাৎ আমার রানারের পায়ে গুলি লাগে এবং সে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে গুলি করার চেষ্টা করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর নাসিমও গুলিবদ্ধ হয় এবং আহত হয়ে পড়ে যায়। আমি অবশেষে জুডো কায়দায় তার বেষ্টনী থেকে মুক্তি পাই এবং আমি জোরের সাথে তার মুখের চোয়ালে এক ঘুষি মারি। তাতে সে পড়ে যায় এবং গিয়ে আমার রানারকে ধরে ফেলে এবং স্টেন দিয়েই আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তার ও আমার মাঝে ব্যবধান ছিল মাত্র খুব বেশি হলে এক গজ। গুলি যে বেরিয়ে গেছে সেটা আমি দেখেছি কিন্তু কোথায় লেগেছে তা লক্ষ্য করিনি।

 সে সময় আমাদের “একজন সৈন্য সেখানে রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি তার কাছ থেকে রাইফেলটা নিয়ে সে সুবেদারের মাথায় বাড়ি দেই। সুবেদার মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি রাইফেল দিয়ে তার মাথায় কয়েকবার আঘাত করছিলাম। সে সময় আমাদের কোন সৈন্যই অবস্থানে ছিল না। তাদের সবার অবর্তমানে। ঐ সুবেদারকে মেরেছিলাম। আমরা যখন ধস্তাধস্তি, গোলাগুলিতে বাস্ত ছিলাম তখন আমাদের সম্মুখে যে কোম্পানী অগ্রসর হচ্ছিল তারা পেছনের দিকে আসে এবং যারা পেছন থেকে আসে তারাও সম্মুখে অগ্রসর হয়। ঠিক এ সময় আমি দেখি যে আর একখান গাড়ী পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা একটা বাস ছিল। সে বাস থেকে অবতরণ করছিল পাকিস্তানী সৈন্য। আমি তা দেখে রাইফেল উঁচিয়ে তাদের উপর গুলি করতে প্রস্তুতি নেই। কিন্তু দেখলাম যে রাইফেলটা ভেঙ্গে গেছে। রাইফেলটা ছুড়ে ফেলে আমি চিৎকার করে বলি আমার স্টেন কোথায়? এবং সাথে সাথে পিস্তল বের করি। পিস্তল বের করে দেখি সেটাও বিকল হয়ে গেছে। তখন বুঝতে পারলাম সুবেদার যখন আমাকে এসএমজি দিয়ে গুলি করেছিল তা পিস্তলে লেগেছিল। পিস্তলে দুটো গুলির আঘাত বিদ্যমান ছিল। পিস্তলটাকে আমি আবার পাউচ-এর ভিতর রেখে কোন উপায় না দেখে এক