পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
218

পাকবাহিনীর গাড়ী ধ্বংস হয় এবং ৭০ জন মারা যায়। ২টি ট্রাক এবং একটি বাস, চিঠিপত্র এবং অনেক গোপন তথ্য আমাদের হস্তগত হয়।

 সম্মুখযুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে আমরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। এতে করে আমরা কৃতকার্য হতে লাগলাম। দুইবার একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি। বুলেট লুঙ্গি ও হাফহাতা জামার হাতা ভেদ করে গেছে কিন্তু আমার শরীর স্পর্শ করেনি।

 ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী পুনর্গঠিত করতে থাকি। বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে এসে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু নিতে থাকি এবং সার্বিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে সম্মুখ সমরে আসতে হয়। আমাদের উপর নির্দেশ আসে শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করে, ধ্বংস কর, অস্ত্র কাড়ো, এগিয়ে যাও। আমরা তখন দলে বেশ ভারী হয়ে চলেছি, অস্ত্রশস্ত্রও বেশ আছে। আমরা কাজ আরম্ভ করে দেই। সেপ্টেম্বর মাসেই একাদশ বেঙ্গল তৈরী হয়। পুরাতন আর্মি, মুজাহিদ, আনসার এবং ছাত্র মিলে ব্যাটালিয়ন পুরা করা হয়। কোন সময়ে আমি একা, কোন সময়ে দুই কোম্পানী মিলে, কোন সময়ে তিন কোম্পানী মিলে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাঝামাঝি পর্যন্ত। হরশপুর, মুকুন্দপুর, তেলিয়াপাড়া, মনতলা, সিলেট, সাজিবাজার, শাহপুর ইত্যাদি স্থানে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে আমরা জয়লাভ করি। শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারী আমাদের মাঝে মাঝে সাহায্য করতো।

 ৩০শে নভেম্বর আমার উপর নির্দেশ আসে আখাউড়া দখলের জন্য। ১লা ডিসেম্বর আমি, মিত্রবাহিনী, ২য় বেঙ্গলের বাহিনী সম্মিলিতভাবে আমরা আখাউড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ঘিরে ফেলি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আক্রমণ চালাই। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়- ১লা ডিসেম্বর তারিখে শুরু হয়, ৬ই ডিসেম্বর সকালে আখাউড়া আমাদের দখলে আসে। কর্নেল শফিউল্লাহ আমাকে মাধবপুরে রওনা হয়ে যেতে বলেন। কর্নেল নিজে ১১ বেঙ্গল এবং ২য় বেঙ্গল নিয়ে ব্রহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হলেন বললেন রাস্তায় দেখা হবে। ঐ দিন ২টার দিকে আখাউড়া থেকে রওনা দেই, পুরাতন ক্যাম্প মনতলাতে রাত ১০/১১ টার দিকে পৌঁছাই। সকালে মাধবপুরের দিকে অগ্রসর হবার মনস্থ করি। ৭ই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় মেজর নূরুজ্জামান আমার ক্যাম্পে এসে একটি দুর্ঘটনার খবর দেন এবং আমার কোম্পানীকে রেখে আমাকে একাদশ বেঙ্গলের দায়িত্ব নিতে বলেন। মেজর বলছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন হঠাৎ করে সিলেটের রামপুরে পাকবাহিনীর ৪০/৫০ জনের একটি দল আক্রমণ চালায়। ওখানে পাঞ্জাবী সুবেদারের সাথে কর্ণেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি হয় কিন্তু শফিউল্লাহ বুদ্ধি বলে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সুবেদারকে আঘাত করে ধরাশায়ী করেন। ২ জন মুক্তিবাহানী মারা যায়। ১০/১২ জন আহত হয়। মেজর নাসিম গুরুতর রুপে আহত হয়। কর্নেলের পিস্তল যেখানে গুলি লেগে পিস্তলটি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু কর্নেল বেচেঁ যান। ১৫/১৬ জন পাঞ্জাবী মারা যায়, বাকি সব আত্মসমর্পণ করে একাদশ বেঙ্গলের কাছে।

 কর্নেল সাহেবের সাথে দেখা করে একাদশে বেঙ্গলের দায়িত্ব নেই এবং তিনি ঐ রাতেই মাধবপুর, শাজবাজপুর সরাইল হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। ৭ই ডিসেম্বর রাতে পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হই। ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হস্তগত করি। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলেও আমাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় আশুগঞ্জ দখলের জন্য নির্দেশ দেন কর্নেল শফিউল্লাহ ১১ই ডিসেম্বর। ১১ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ দখল করি। ভৈরব সেতু ধ্বংস করে ভৈরব শহরে পাকবাহিনী আস্তানা গাড়ে। মিত্রবাহিনী এবং কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় বেঙ্গল নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার পথে রওনা হন আমাকে আশুগঞ্জে রেখে। আমাকে নির্দেশ দিয়ে যান আমি আমার বাহিনী নিয়ে পাক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখি, যাতে তারা ঢাকার পথে পিছন দিক থেকে গিয়ে কর্নেল শফিউল্লাহ বা মিত্রবাহিনীর কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমরা দুই দিক থেকে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখলাম। মাঝে মধ্যে আক্রমণ করে আমরা