পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
231

 মেজর মতিনের কোম্পানীটি ছিল পুরোপুরি প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের বাহিনী দ্বারা সংগঠিত। আমি এবং মেজর মতিন যখন তেলিয়াড়ায় লড়াই করেছি তখন কি রকম নিস্কম্প হৃদয়ে ঐ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের জোয়ানরা লড়াই করেছে। মেজর মতিনের ই-পি-আর কোম্পানী পরবর্তীকালেও বিভিন্ন ফ্রণ্টে খুব সাহসের সঙ্গে লড়েছিল। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের প্রশংসা না করে আমি পারি না।

॥ চুড়ান্ত লড়াই ও আখাউড়ার যুদ্ধ ॥

 নভেম্বরের ২০ তারিখের পরে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। যশোরের কাছে পাকিস্তানের স্যাবর জেটগুলো ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করায় আকাশযুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান আক্রমণে ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। এতে যুদ্ধের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে এ সময় যশোরের চৌগাছা পতন হয়। এবং তারা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যের সঙ্গে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।

 নভেম্বরের এই সময়টাতে আমরা আখাউড়ার শত্রুসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। শত্রুর বিরুদ্ধে এবার আমরা পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করি। আমাদের আক্রমণও একই রকম তীব্র এবং প্রচণ্ড। এ সময় ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহর অধীনে ছিল পুরো দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য। এই দুই ব্যাটালিয়নই ছিল যাবতীয় সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত। এ-ছাড়াও ছিল কয়েকটা কোম্পানী যাকে আমরা সেক্টর ট্রুপস বলতাম।

 কর্নেল শফিউল্লাহ ‘এস’ ফোর্সের ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার মেজর মঈন এবং ১১নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার মেজর নাসিমকে এই মর্মে নির্দেশ দিলেন যে মেজর মঈনের ব্যাটালিয়ন আখাউড়ার দিকে আক্রমণাত্মক অভিযান চালাবে এবং তাদের সাথে থাকবে সেক্টর ট্রপস, আর মেজর নাসিমের ব্যাটালিয়ন (১১ নং বেঙ্গল রেজিমেণ্ট) আগরতলা উত্তর দিকে ধর্মঘরের ওখানে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেবে যাতে করে সিলেট থেকে মনতলা হয়ে পাকবাহিনী পেছন থেকে আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে না পারে। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ধর্মঘরের সামনে রেখে মোহনপুর-আগরতলা রোডে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ সময় আমি একটি কোম্পানীর নেতৃত্বের ভার নেই। শত্রু যাতে মোহনপুর-আগরতলা রোড ধরে অগ্রসর হতে না পারে সে উদ্দেশ্যই আমরা আখাউড়া যুদ্ধের আগেই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সে সময় আমি যে কাম্পানীর পরিচালনার নেতৃত্ব নিয়েছিলাম সেটি বি-কোম্পানী।

 ওদিক তখন আখাউড়ায় কি ঘটেছিল তার কিছুটা বিবরণ, আমি যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, দেওয়া যাক। ২৭শে নভেম্বর কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর মঈনকে মেরাসানী, নিরানসানী, সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশনে, সিঙ্গারবিল ঘাঁটি, রাজাপুর, আজমপুর ইত্যাদি এলাকা দখল করার নির্দেশ দেন। উল্লেখযোগ্য যে, এই সব এলাকা আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের কাছাকাছি। কর্ণেল শফিউল্লাহ মেজর মঈনকে ৩০শে নভেম্বর এবং ১লা ডিসেম্বর তারিখ রাতে এই সব এলাকায় আক্রমণ চালাবার আদেশ দিয়েছিলেন।

 মেজর মঈন দ্বি-ধারা আক্রমণ চালালেন। প্রথম আঘাত হানলেন নভেম্বর-ডিসেম্বর ৩০/১ তারিখ রাত ১টার সময়। প্রথম পর্যায়েই দখল করলেন সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশন ও সিঙ্গারবিল ঘাঁটি। শুনেছি, সে রাতে লড়াই চলেছিল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত।

 এই অভিযান আমাদের পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রায় এক ব্যাটালিয়ন। শত্রুপক্ষের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী। এই যুদ্ধে শত্রুসেনারা আর্টিলারী, মর্টার, মেশিনগান ইত্যাদি ছোটবড় সব অস্ত্রশস্ত্রই ব্যবহার করে। আমাদের পক্ষেও সেদিনকার লড়াইয়ে আর্টিলারী এবং মর্টারের সাপোর্ট ছিল। সেক্টর ট্রুপসের কাছেও ছিল মেশিনগান।