পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
1

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১। ১নম্বর সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ - মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম[১] বীর উত্তম, ঢাকা, ১৯৮১ ১৯৭১

বিলম্বিত কনফারেন্স

 ১০ই জুলাই আমি আগতলা থেকে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একখানি বিমানে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে গৌহাটিতে আধ ঘণ্টার জন্য থেমে রাত সাড়ে আটটার দিকে কলকাতার আকাশে পৌঁছে গেলাম। নীচে তখন মুষলধারায় বৃষ্টির সাথে বেগে বাতাস বইছিলো। এহেন দুর্যোগে কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমাদের বিমান রানওয়ে স্পর্শ করলো। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমার চার ঘণ্টার কষ্টকর যাত্রা শেষ হলো। রাত তখন ৯টা।

 অচেনা কলকাতায় আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত আগন্তুক। বিমান বন্দরের ভবনে কিছুক্ষণ পায়চারী করার পর একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। শিখ ড্রাইভারকে বললাম বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে। কিন্তু রাতে আর্মি হেডকোয়ার্টার খুঁজে পেলাম না। তখন ড্রাইভারকে মাঝারি ধরনের একটি হোটেলে নিয়ে যেতে বললাম।

 বহুদিনের পরিচর্যার অভাবে আমার চুল, দাড়ি সমানে বেড়ে উঠেছিলো। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো জোড়া ছেঁড়া ও ময়লা, গায়ে বেঢপ মাপের জামাটিও আকারে বেশ বড়, পরনে ট্রাউজার এং হাতে কিছু সরকারী কাগজপত্র ভর্তি একটি কাপড়ের থলে, এই ছিলো আমার সেদিনকার সর্বাঙ্গীণ চেহারা। শিখ ড্রাইভার নিশ্চয়ই আমার সাথে রসিকতা করে থাকবে। সে আমাকে একটি ব্যয়বহুল হোটেলে পৌঁছে দিলো। হোটেলে ঢুকতেই অনুভব করলাম রিসেপশন রুমটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমি যেন হঠাৎ করে দারুণ একটা আঘাত পেলাম। মনের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে আমার থলেটি স্পর্শ করলাম। সেখোনে উপস্থিত সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত পুরুষ ও মহিলাদের বিস্মিত দৃষ্টির মুথে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মুহূর্তে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাস করলাম, “একটা রুম পাওয়া যাবে কি?” ভদ্রলোক আড়চোখে আমার পা থেকে মাতা পর্যন্ত একটু জরিপ করে নিলেন। আমার জুতো, ট্রাইজার, শার্ট, থলে, দাড়ি কোন কিছুই তার দৃষ্টি এড়ালো না। তারপর কিছুটা কৌতুহলের হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি...?” “হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি”, সাথে সাথে জবাব দিলাম।

 পরদিন সকালে হোটেল ত্যাগ করলাম। কিন্তু এক রাতের ভাড়া হিসাবে পকেটে যা ছিল অর্ধেকটা বেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার সারাটা পথে আমি শুধু সেই শিখ ড্রাইভারকে অভিসম্পাত করছিলাম।

 ১১ই থেকে ১৭ই জুলাই পর্যন্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনের আলোচনা সকালে শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। সেখানে সকল সেক্টর কমাণ্ডারই উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে আমরা নানা ধরনের সমস্যা এবং সমন্বিত ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করি। উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত আমাদের চিন্তার কিংবা কাজের কোন সমন্বয় ছিলো না।

 কলকাতা ৮ নম্বর থিয়টার রোডের ভবনটিতে আমরা মিলিত হয়েছিলাম। এটা ছিলো বিএসএফ-এর অফিস। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারকে এটি ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছিলো।


  1. একাত্তরের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম সাবেক ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন পদে সেক্টর এ্যাডজুটেণ্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন।