পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
238

কিছুসংখ্যক সৈন্য দিয়ে আক্রমণ চালানো আর বাকি সৈন্য দ্বারা লাটুর বাঁয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে লাটুর উপর পুরোপুরি আক্রমণ চালিয়ে দখল করা। লাটু- বড়লেখা রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যাতে পাকসেনারা বড়লেখা হতে অগ্রসর হতে না পারে এবং বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের কাছে কোন অয়ারলেস সাজসরঞ্জাম ছিল না। তাই একদলের সাথে অন্যদের যোগাযোগ ছিল না। আগস্টের শেষের দিকে ভোর চারটায় আক্রমণ শুরু হল। বেলা সাড়ে এগারটায় লাটু-বড়লেখা রাস্তায় মাইন পোঁতার জন্য যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল তারা সাড়ে এগারটায় ফিরে আসে। দুইজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল মাইন পোঁতার সময়। তাদের সবাইকে মেজর রবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চলতে থাকে। বেলা প্রায় দুটোর সময় দেখা গেল যে পাক সেনারা বাঙ্কার ছেড়ে পেছনে চলে যাচ্ছে। পরক্ষণেই আরম্ভ হল শত্রুসৈন্যর লাটুর উপর গোলাগুলি নিক্ষেপ। বোঝা গেল বড়লেখা থেকে শত্রুসৈন্য লাটুতে এসে যোগ দিয়েছে। শত্রুদের কাছ থেকে ৩ ইঞ্চি এমজি'র গোলাগুলি আসতে লাগল। বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা। শত্রুদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছনে চলে আসতে শুরু করে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল।

 সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আবার আক্রমণ চালানো হল। সারোপার এবং লাটু এ দুটো জায়গা আবার দখল করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। তুমুল যুদ্ধের পর সারোপার আমাদের হস্তগত হয়। সারোপার দখলে একটা সুবিধা হল যে শত্রুসৈন্যর এখন কুলাউড়া থেকে সিলেটে সরাসরি আসা বন্ধ হয়ে গেল। পুরো সেপ্টেম্বর মাসটা লাটু, বড়লেখা এমনি ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত আমাদের আক্রমণ চলতে লাগল। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার সাদী তার সৈন্যদের নিয়ে চা-বাগানে আক্রমণ চালায় এবং দুদিন তুমুল যুদ্ধের পর পুরো লুবাছড়া-কাড়াবালা আমাদের হস্তগত হয়। লুবাছড়া মুক্ত হবার পর পাকিস্তানীরা বার বার চেষ্টা চালিয়েছে লুবাছড়া দখল করার জন্য, কিন্তু লুবাছড়া পুনরায় দখল করতে তারা সমর্থ হয়নি। লুবাছড়া স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত মুক্ত ছিল। আমাদের আক্রমণের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী লুবাছড়া থেকে নির্ধারিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা খাজা নিজাম উদ্দীনসহ নিম্নলিখিত মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছিল এবং তাদের বীরত্বের জন্য লুবাছড়া আমাদের হস্তগত হয়েছিল। তাদেরকে এ ওয়ার্ড দেয়ার জন্য আমি সি-ইন-সি'র কাছে অনুরোধ করেছিলাম।

 নিহতারা হলোঃ ১। খাজা নিজামুদ্দীন বীর শ্রেষ্ঠ। ২। রফিক উদ্দীন বীরোত্তম। ৩। মোহাম্মদ বশির আহম্মদ বীরপ্রতীক। ৪। মোহাম্মদ মইজুল ইসলাম বীর প্রতীক। ৫। মোহাম্মদ শাহাবউদ্দীন বীরশ্রেষ্ট। ৬। মোহাম্মদ হোসেন। ৭। আতিকুল ইসলাম বীরপ্রতিক। ৮। আশরাফুল হক বীরোত্তম। ৯। মাহমুদূর রব বীরোত্তম।

 নয়টা গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি মৌজা-নাম ন’ মৌজা। এটি ভারতের কৈলাশশহের বিপরীতে অবস্থিত ছিল। লেঃ ওয়াকিউজ্জামানের নেতৃত্বে ন’ মৌজায় পাকিস্তানী ঘাঁটির উপর আঘাত হানা হল এবং ন’ মৌজাকে শত্রমুক্ত হরা হল। এমনিভাবে লুবাছড়া, কাড়াবালা, মোকামটিলা, আমলসিদ, ন মৌজা আমাদের দখলে আসে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানীদের উপর আঘাত করা হল এই সমস্ত ঘাঁটি হতে।

 অক্টোবরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ১ম এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে আমার সেক্টরে যোগ দেন। তাতে আমার শক্তি অনেক বেড়ে যায়। ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট মেজর আমিনের নেতৃত্বে (বর্তমানে দুজনই লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল) সিলেটের চা বাগানগুলোর উপরে আক্রমণ চালানো হয়। পরিকল্পনা ছিল চা বাগানগুলো শত্রুমুক্ত করে আমরা সবাই মিলে সিলেটের দিকে অগ্রসর হব। ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট প্রথমে আঘাত হানল কেজুরীছড়া চা বাগানের উপর। সঙ্গে সঙ্গে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আঘাত হানল ফুলতলা- সাগরনাথ চা বাগানের উপর। এমনিভাবে সেক্টর ট্রুপস এবং ‘জেড' ফোর্স পুরো সিলেট জেলার উপর একটার পর একটা আঘাত হানতে শুরু করল এবং পাকিস্তানীদের পর্যুদস্ত করতে শুরু করল। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট দক্ষিণগুলো চা বাগানের উপর আক্রমণ চালালো। শত্রুদের ২২