পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
239

বেলুচ রেজিমেণ্ট ওখানে ছিল। পাকিস্তানীরা আনেকবার দক্ষিণগুলের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট দক্ষিণগুল হাতছাড়া করেনি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম দক্ষিণগুলে ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারী দক্ষতার সাথে এবং কার্যকরীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। দক্ষিণগুল জয়ের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে ১০৫ আর্টিলারীর সাফল্যজনক ব্যবহার অনেকাংশ সাহায্য করেছিল। ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারী ব্যবহারের প্রশিক্ষণ সিলেট সেক্টর আমারই তত্ত্বাবধানে ক্যাপ্টেন রশীদের পরিচালনায় সর্বপ্রথম হয়েছিল। আমার যতদূর মনে হয়, ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারীকে পরবর্তীকালে মুজিব ব্যাটারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

 নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আট-গ্রাম-জাকীগঞ্জ দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। কারণ জাকীগঞ্জ সিলেটের এক কোণে অবস্থিত। ভারতের করিমগঞ্জ শহরটি ঘেঁষে জাকীগঞ্জের অবস্থিতি। মাছখানে ছোট্ট একটি নদীর ব্যবধান। জাকীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানীরা শিলচর-করিমগঞ্জ রেলওয়ে লাইনের উপর রাতের অন্ধকারে মাইন পুঁতে রাখত। তার ফলে দু'দুবার মালবাহী ট্রেন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। এতে আমরা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতাম, কারণ বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীরা এসে বন্ধুরাষ্ট্রের ক্ষাতিসাধন করছে। তাই জাকীগঞ্জ দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। সেক্টর ট্রুপস এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে নিয়ে হামলা চালানো হল। জাকীগঞ্জের এই যুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা কোনদিন ভুলবার নয়। তাদের সাহায্য না পেলে হয়ত জাকীগঞ্জ আটগ্রাম শত্রুমুক্ত করা সহজ বা সম্ভব হত না। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর জাকীগঞ্জ আটগ্রাম আমাদের দখলে আসে। দখলের পর ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আটগ্রামে অবস্থান করছিল। ভরতের ৯৯তম মাউণ্টেন রেজিমেণ্টকে জানাই আমার সালাম।

 খবর আসতে লাগল শত্রুসৈন্য সমস্ত সিলেট জেলায় আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছে। তারা রাতে ভয়ে কোথাও বের হত না, পাকিস্তানীদের একা একা কোথাও দেখা যেত না। গেরিলা অপারেশন অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। পাকিস্তান সোনাবাহিনী গেরিলা অপারেশনের সফলতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের ঘাঁটি থেকে বের হতে সাহস করত না। তাদের চলাফেরা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

 সিলেট জয় করতে হলে কানাইঘাট দখল করা সর্বপ্রথম প্রয়োজন। আমি সেক্টর ট্রুপস নিয়ে কানাইঘাট জয়ের জন্য লুবাছড়ার দিকে অগ্রসর হয়ে ওদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নিলাম। আমার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের রাইফেলের ছেলেরা, আনসার, মোজাহিদ, পুলিশ ও স্কুল-কলেজের ছাত্ররা। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ জন। লুবাছড়া পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে আসল। চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে কানাইঘাট দখল করা যায়। আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছিল যেভাবে হোক কানাইঘাট দখল করতে হবে।

 সিলেট সেক্টর ট্রুপস কানাইঘাটের যুদ্ধ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর সেক্টর ট্রপস অগ্রসর হল। সৈন্যসংখ্যা চারশোজনকে নিয়ে চারটি কোম্পানী গঠন করা হল। একটা কোম্পানীকে লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসের নেতৃত্বে দরবস্ত -কানাইঘাট রাস্তার মধ্যে 'কাট অফ কোম্পানী' হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হল। ওর কাজ ছিল শত্রুসৈন্য দরবস্ত হতে কানাইঘাট যুদ্ধে যেন কোন সাহায্য করতে না পারে। লেফটেন্যণ্ট জহীরকে আর একটি কোম্পানীর দায়িত্ব হতে কানাইঘাট-চোরঘাই রাস্তায় 'কাট অফ কোম্পানী’ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হল। ওকে এই দায়িত্ব দেয়ার কারণ হল চোরঘাই থেকে যেন শত্রুসৈন্য কানাইঘাটে সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে এবং কানাইঘাট থেকে শত্রুসৈন্য পালিয়ে চোরঘাইর দিকে না যেতে পারে। আর দুটো কোম্পানী মেজর রব (বর্তমানে লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল)-এর অধিনায়কত্বে নদীর পাড় ও মধ্য দিয়ে শত্রুর উপর হামলা চালিয়ে কানাইঘাট দখলের দায়িত্ব দেয়া হল। রাতের অন্ধকারে কানাইঘাট যুদ্ধ জয়ের অভিযান শুরু হল। রাত দেড়টায় গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসের সঙ্গে শত্রুসৈন্যর গুলি বিনিময় হচ্ছে। লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসের কোম্পানী জায়গায় পৌঁছতে পারছে না। ইতিমধ্যে তার