পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
240

একজন সৈন্য আহত হয়। আমি তাকে বললাম যেভাবে হোক তোমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। লেফটেন্যাণ্ট জহীরের কাছ থেকে খবর আসল সে বিনা বাধায় কানাইঘাট-দরবস্ত রাস্তা পার হয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত যত বাড়তে লাগল ততই গোলাগুলির আওয়াজ বাড়তে লাগল। রাত প্রায় দুটোর সময় লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসের কাছ থেকে খবর পেলাম ওরা শত্রুসৈন্যকে ঘিরে ফেলেছে, তবে তার একটি ছেলে শহীদ হয়েছে এবং সে শত্রুদের উপর শেষ হামলা চালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম তার গন্তব্যস্থল প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে, তার উপর ভীষণভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ হচ্ছে এবং সে এগুতে পারছে না। মেজর রবের কাছ থেকে খবর পেলাম তার দুটো কোম্পানী ধীরগতিতে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সে এখনও মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়নি। লেফটেন্যণ্ট গিয়াসের কাছ থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর রাত তিনটার সময় খবর আসল শত্রুদের একটি পুলের চার কোনায় চারটি বাংকার। এবং তার ভেতর থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি আসছে। লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসের সৈন্যরা বাংকারের উপর গ্রেনেডের সাহায্যে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভেতর থেকে বাংলায় চীৎকার করে বলল, “আমরা বাঙ্গালী, আমাদের মারবে না। দুটো পশ্চিম পাকিস্তানী রাস্তার উপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আপনাদের সাহায্য করব।” রাত প্রায় সাড়ে তিনটে-চারটে হবে। লেফট্যানেণ্ট গিয়াসের কাছ থেকে খবর পেলাম ওরা ওদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে। বাংকারের ভেতরে ওরা যেতে পারেনি। কারণ বাংকারে অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে। এবং ৭ জন রাজাকার বাইরে চলে এসে আত্মসমর্পণ করেছে। নয়জন পশ্চিম পাকিস্তানী গ্রেনেড ছোড়ার ফলে মারা যায়। দু'জন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাবার সময় মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলে। ৭ জন বাঙালী রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসকে পুরো এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলো যাতে দরবস্ত থেকে শত্রুরা কানাইঘাটের দিকে আসতে না পারে। রাত বাড়তে লাগল, লেফটেন্যাণ্ট জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম সে এগুতে পারছে না। এদিকে মেজর রব শত্রুসৈন্যর মুখোমুখি প্রায় এসে পড়েছে। তার উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হচ্ছে। বেলা বাড়তে লাগল- মেজর রব শত্রুসৈন্যকে নদীর তীর দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। সে ওদের কাছ থেকে দুশো গজ দূরে আছে। তার দুটো ছেলে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। তার গোলাবারুদ দরকার বলে সে জানাল। ৪ঠা ডিসেম্বর সকাল ৬টায় জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম এম-জি এবং মর্টারের গোলাগুলিতে সে এগুতে পারছে না। তিনজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে। আরো সৈন্য এবং গোলাবারুদ চেয়ে সে অনুরোধ জানাল। আমি বললাম, সৈন্য আর পাঠাতে পারব না, তবে গোলাবারুদ পাঠিয়ে দিচ্ছি। সকাল ৭টায় মেজর রবেব কাছ থেকে খবর পেলাম নদীর ওপার থেকে ওদের উপর গোলাগুলি আসছে। আমি জানতাম আটগ্রামে ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আছে এবং এটাও জানতাম নদীর ওপারে শত্রুসৈন্য আছে। ১ম বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নদীর ওপার থেকে শত্রুসৈন্যদের সরিয়ে দিতে। আমার সঙ্গে ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং 'জেড'- ফোর্স- এর বেতার যোগাযোগ ছিল না। মেজর রবের উপর নদীর ওপার থেকে গোলাগুলি আসতে লাগল। মেজর রবকে বললাম, ভারতের সাথে বেতার যোগযোগ করে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য আমি নিচ্ছি। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যাও। ভারতের সাথে যোগাযোগ করি এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য পাবো বলে তারা আশ্বাস দেয়। এদিকে, যেহেতু মেজর রবের আরো সৈন্যর দারকার ছিল সেইহেতু জহীরকে মেজর ববের সাহায্য পাঠানো হল। লেফটেন্যাণ্ট গিয়াসের কাজ থেকে খবর পেলাম দরবস্ত থেকে পাকিস্তানীদের কানাইঘাটের দিকে আসার কোন পরিকল্পনা আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। গিয়াসকে লেফটেন্যাণ্ট জহীরকে সাহায্যের জন্য পাঠানো হল। মেজর রব এবং লেফটেন্যাণ্ট জহীরের দলের উপর শত্রুরর ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছিল। আস্তে আস্তে ওরা এগুতে লাগল। বেলা প্রায় দশটায় খবর পেলাম নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানীরা পেছনে পালাচ্ছে। এদিকে কানাইঘাট থেকেও পাকিস্তানীরা বাংকার থেকে উঠে পড়েছে। কানাইঘাটে শত্রুদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেলা প্রায় সাড়ে দশটায় মেজর রব, লেফটেন্যাণ্ট গিয়াস ও লেফটেন্যাণ্ট জহীরের সৈন্যরা সম্মিলিতভাবে কানাইঘাটে শত্রুসৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তানীরা রাস্তা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে আরম্ভ করল এবং নিজেদের পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে নিজেরাই মরতে আরম্ভ করল। যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল ওরাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। নদীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিল। অনেকে পানিতে