পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
241

ডুবেও মারা যায়। ভীষণ শব্দে মাইনগুলো ফাটছিল। যারা চুরবাইর দিকে পালাতে চেষ্টা করেছিল তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। বেলা প্রায় এগারটায় কানাইঘাট আমাদের দখলে আসল। কানাইঘাটে শত্রুসৈন্যেও অনেক লাশ ছিল। লাশগুলোর সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চারধারে “জয় বাংলা ধ্বনি, ছেলেদের মুখে হাসি। মনটা গর্বে ভরে উঠল। কানাইঘাট জয়ের কথা জানানো হল। নানা জায়গা থেকে আমাদেরকে অভিনন্দন জানানো হল। জেনারেল ওসমানীর কাছ থেকেও অভিনন্দন বার্তা পেলাম। কানাইঘাট যুদ্ধে পাকিস্তানীদের মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০ জন, আহত ছিল ২০ জন। বাঙ্গালী রাজাকার ছিল বিশজন। তারা পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়াতে ওদেরকে মুটে-মজুরের কাজ দেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে শহীদ হয়েছে এগারজন। এবং আহত হয়েছিল ১৫ জন। আমার ডাক্তার ছিল সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র নজরুল। যেভাবে সে আহতদের চিকিৎসা করেছে তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম কখনো ব্লেড গরম করে, কখনো বেয়নেট গরম করে কাটাছেঁড়া করছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে সে।

 এত বড় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি বলে যারা ভাল কাজ করেছে তাদেরকে উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সর্বাধিনায়কের কাছে নাম পাছিয়েছিলাম। তারা হলঃ ১। মেজর রব বীরোত্তম। ২। লেফটেন্যাণ্ট জহিরুল হক বীরপ্রতীক। ৩। সুবেদার মতিন বীরোত্তম। ৪। সুবেদার বাছর আলী বীরোত্তম। ৫। নায়েক সুবেদার শামসুল হক বীরোত্তম। ৬। হাবিলদার মোহাম্মদ শাহ আলম (শহীদ) বীরশ্রেষ্ঠ। ৭। হাবিলদার আবদুল জব্বার বীর প্রতীক। ৮। সিপাহী কামাল উদ্দীন বীর প্রতীক। ৯। নায়েক আলি আকবর বীর প্রতীক। ১০। এফ, এফ, নূরউদ্দীন আহমদ বীরোত্তম। ১১। এফ, এফ, নীলমণি সরকার।

 কানাইঘাট জয়ের পর খবর আসল আমাকে দরবস্ত হয়ে সিলেট যেতে হবে। দরবস্ত জায়গাটা হল তামাবিল এবং সিলেটের মধ্যে। খবর পেলাম দরবস্তে এক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য আছে। যদি দরবস্ত শত্রুমুক্ত করা না যায় তাহলে সিলেটে আমাদের পাওয়া যাবে না এবং তামাবিল ও গোয়াইনঘাট হতে আমদের যে সৈন্য আসছে ওরাও সিলেট যেতে পারবে না। তাই যেভাবে হোক দরবস্ত শত্রুমুক্ত করতে হবে। আমার এই অভিযান শুরু করার কিছুক্ষণ আগে সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে খবর পেলাম জেড-ফোর্সকে আমার এক কোম্পানী দিতে হবে, কারণ ওর সৈন্যসংখ্যা কম। লেফটেন্যাণ্ট জহীরকে জেড-ফোর্সের ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে সাহায্য করার জন্য দিলাম। যতটুকু আমি জানি মেজর জিয়া ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে এবং সেক্টর ট্রুপসের একটা কোম্পানী নিয়ে শালুটিকর বিমান ঘাঁটির দিকে যাবেন। ওদিকে ভারতের একটা ব্যাটালিয়ন সিলেটের দক্ষিণ দিকে হেলিকপ্টারে ছত্রীসেনা নামিয়ে দেবে। ভারতের ছত্রীসৈন্যের সংগে মিলিত হয়ে মেজর জিয়া তার সৈন্য নিয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। আমার সৈন্য দরবস্ত জয় করে খাদিমনগর হয়ে সিলেটের উপর আক্রমণ করবে। ভারতের আর একটি গুর্খা ব্যাটালিয়ন মুক্তাপুরের ৫নং সেক্টরে একটা কোম্পানী নিয়ে খাদিমনগর হয়ে সিলেটের উপর আক্রমন করবে। মেজর শওকত (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার)-এর সৈন্যদল ও ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট গোয়াইনঘাট-ছাতক হয়ে সিলেটের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। আর একটা বাহিনী ভারতের সাহায্যে মেজর এনামের দায়িত্বে মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। আর একটা বাহিনী ভারতের সাহায্যে লেফটেন্যাণ্ট ওয়ার্কিউজ্জামান এবং ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট কাদেরর সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। এই ছিল সিলেট যুদ্ধের পরিকল্পনা, যতটুকু আমি জানতে পেরেছিলাম।

 শুরু হল দরবস্তের পথে যাত্রা। প্রায় ১৫ মাইল হাঁটতে হয়েছিল। এফ-এফ রবকে দিয়ে একটা কোম্পানী তৈরী করলাম এবং অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিলাম। এফ এফ শুকুরের কোম্পানী রইল তার পিছনে। আমার পেছনে রইল মেজর রব ও সুবেদার ফজলুল হকের কোম্পানী। পেছনে ধরা পড়া রাজাকাররা আনল গোলাবারুদ ও খাদ্য সরঞ্জাম।

 ৬ই ডিসেম্বর বিকেল প্রায় পাঁচটা। সবাইকে এক জায়গায় জড় করলাম। বললাম, যেভাবে হোক দরবস্ত দখলে আনতে হবে। দরবস্তে পাকিস্তানীদের একটা কোম্পানী আছে। দরবস্ত দখল না করলে সিলেট জয় করা