পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
6

সাথে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ই-এম-ই (ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এ্যাও ইকুইপমেণ্ট) বিভাগকে এই কাজের ভার দেয়া হয়।

 চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিলো প্রকট। ভারতের হাসপাতালগুলো আহত শরণার্থীতে ভরে গিয়েছিল। এদের বেশীর ভাগই ছিলো বুলেট কিংবা বেয়োনেটের আঘাতে আহত। আমরা বাঙ্গালী সৈনিকদের জন্য কয়েকটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। পরে সবচাইতে বড় হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল ২ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধের সময় খুব কমসংখ্যাক চিকিৎসকই চিকিৎসকই ভারতে গিয়েছিলেন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ৪র্থ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রদের পর্যন্ত কাজে নিয়োগ করা হয়। তারা চিকিৎসা ক্যাম্প এবং সাব-সেক্টরের দায়িত্বও গ্রহণ করে। ভারতের সামরিক হাসপাতালগুলোতে আমাদের আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করানোর জন্যও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংগে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

 এ রকম আরো অনেক সমস্যার কথা এবং সেগুলোর সমাধানের উপায় নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়। সেক্টরগুলোতে কতগুলো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য এবং যন্ত্রপাতি একেবারেই ছিলো না। এ ব্যাপারে আমাদের চাহিদা ঠিক সময়ে পূরণ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে আমরা কখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই পাইনি কিংবা ঠিক সময়েও পাইনি। হয়তো এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণও থাকতে পারে। বর্ষার সময়ে আমাদের অধিকাংশ সৈনিকের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আচ্ছাদন নির্মাণের কথা ছিলো, কিন্তু কোন সময়েই এ আচ্ছাদনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি। তাঁবুর সাজসরঞ্জাম ও চাহিদা অনুযায়ী কখনো পাইনি। শীতে কম্বলের সংখ্যা ছিলো অল্প, গরম কাপড় তারও কম। আমাদের সৈনিকরা অধিকাংশ যুদ্ধই করেছে খালি পায়ে। জংগলে চলাচলের বুট ছিলো মাত্র কয়েক জোড়া। আমরা বিপুলসংখ্যক প্লাস্টিকের স্যাণ্ডেল পেয়েছিলাম। ওগুলো ছিলো বাথরুমের জন্য উপযুক্ত, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নয়।

 প্রতিটি সেক্টরের সামরিক অভিযানের ক্ষমতা এবং কি পরিমাণ সৈন্য আমাদের আছে সেসব নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। কমাণ্ডো ধরনের হামলার জন্য তখনো আমরা নিয়মিত সৈন্যদের পুরা পুনর্গঠন করতে কিংবা ট্রেনিং দিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশের খুব ভেতরে প্রবেশ করার পরিকল্পনা আমরা কিছুদিনের জন্য বাদ দিয়ে তখনকার মতো সমগ্র সীমান্ত এলাকা বরাবর শত্রুর ওপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নেই। গেরিলা তৎপরতার ওপরেই সবচাইতে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে বিপুলসংখ্যক লোককে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হয়। স্থানীয়ভাবে আমরা স্বল্পসংখ্যক ফ্রিডম ফাইটারকে প্রধানতঃ বিএস এফ-এর সহযোগিতায় ট্রেনিং দেই। যুদ্ধে আমাদের লোকবলের চাহিদা পূরণের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতিমাসে কয়েক হাজার ফ্রিডম ফাইটারকে ট্রেনিং দেওয়ার একটি ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়। আমরা আশা করেছিলাম এর দ্বারা কয়েক মাসের মধ্যে আমরা পর্যাপ্তসংখ্যক গেরিলাকে গড়ে তুলতে পারবো এবং এদেরকে দিয়ে পাকবাহিনীকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত রাখা যাবে। ইত্যবসরে সরাসরি অভিযান পরিচালানার জন্যে নিয়মিত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্গঠন কাজ পূর্ণোদ্যমে চলবে। ফ্রিডম ফাইটারদের ওপর যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি ধ্বংসের দায়িত্ব থাকবে। প্রয়োজনে তারা শত্রুদলকে অ্যামবুশ করবে এবং সশস্ত্র ঘাঁটি, জ্বালানি ও অস্ত্রপাতি মজুতের স্থান কিংবা অন্যান্য সরবরাহ কেন্দ্রের ওপর হামলা চালাবে। এরপর নিয়মিত বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানে শত্রুপক্ষকে সহজেই কাবু করা যাবে।

 এইভাবে আমরা চূড়ান্ত রণকৌশল নির্ধারণ করি। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়, কে কখন সেই সর্বাত্মক অভিযান চালাবে।

 তখনকার মতো যুদ্ধের জন্য সর্বাধিকসংখ্যাক লোককে ট্রেনিং দেয়ার ব্যাপারেই আমরা বেশী আগ্রহী ছিলাম। ট্রেনিং কর্মসূচীর মেয়াদ ছিলো দুই থেকে তিন সপ্তাহের। এই সময়ের মধ্যে তারা রাইফেল, লাইট মেশিনগান, হ্যাণ্ড গ্রেনেড, বিস্ফোরক প্রভৃতি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখতো। এছাড়া অ্যামবুশের কায়দা-কানুন এবং রণাঙ্গনের বিভিন্ন কৌশল কিছু শেখানো হতো। আমাদের সব প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিলো গুণগত নয়, পরিমাণগত নয়, পরিমাণগত দিক