পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
291

 নভেম্বরের দিকে আমার স্ট্রেনথ আরো বেড়ে গেলো। চার্লি ও ডেল্টা নামক দুটো কোম্পানী এসে মিলিত হওয়ায় তখন আমি শওকত সাহেবের নির্দেশে চার্লি এবং ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে আদারপাড়ে চলে গেলাম। ওদের নেতৃত্বের অভাব ছিল। এলাকায় আমি যাওয়ার আগে কোন প্রতিরোধব্যুহ ছিল না। আমি গিয়ে পাটনিগাঙ পর্যন্ত প্রতিরোধব্যূহ রচনা করলাম। সে সময় আমার সামনে ছিল ২৫ বালুচের একটি কোম্পানী, একটি স্কাউট ও আজাদ কাশ্মীর ট্রপস।

 নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ্যামবুশ, রেইড করেছি-পাকিস্তান রাজাকারদের বিভিন্নাবস্থানের উপর, বিভিন্ন পেট্রোল পার্টির উপর। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপারেশনে ৩৪ জন নিয়মিত পাকসেনা, প্রায় এক কোম্পানী রাজাকার নিহত এবং আহত হয়। আমার পক্ষের দু'জন শহীদ এবং ৮ জন আহত হয়।

 খাইরাই স্কুলে শত্রুর হেডকোয়ার্টার ছিল। ৫ই ডিসেম্বর নোয়া পাড়ায় সর্বপ্রথম এনেমি ডিলেইন ফেইস করি। সেখানে শত্রুরা এল-এমজি ফায়ার করে। এলএমজি ফায়ারের সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেলেরা বসে গেল। রেগুলার ট্রেইগু ছেলে ছিল না কেউ, কাজেই এদের বোঝাতে আমার বহু সময় লাগলো যে এটা পাকিস্তান আর্মির ডেলিইন পজিশন। ওরা ভেবেছিল পাকিস্তান আর্মি এসে গেছে। তারপর যখন আমি ডেলিইন পজিশনের ওপর বিশজন ছেলে নিয়ে চার্জ করি, তখন পকিস্তান সেনাবাহিনী উইথড্র করে চলে গেছে। তারপর আমার কথা ওদের কাছে সত্য মনে হলো এবং মনোবল ফিরে এলো। যখন দেখলো আমি চার্জ করে উঠে দাড়িয়েছি এবং কোন কিছু হচ্ছে না তখন তারা বুঝতে পারলো যে পাকিস্তান আর্মি ডিফেন্সে নেই। তারা ব্যাক করছে, পালাচ্ছে।

 তারপর ওখানে রিঅরগানাইজ করে এগুতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত খাইরাই পৌঁছে গেলাম। শত্রুর হেডকোয়ার্টারের পাঁচশ গজ দূরে একটা এলাকায় পৌছলাম। এবং ডিগিং শুরু করে সামনের দিকে যখন রেকি করতে শুরু করলাম তখন পাকসেনা সন্ধ্যায় আবছা আঁধারে আমাদের ওপর মর্টার দিয়ে ফায়ার করলো-কিন্তু আমাদের পজিশন ঠিক বুঝতে না পারায় আমাদের ঠিক লাগছিল না। আমার ছেলেরা অত্যন্ত ক্লান্ত ছিল বলে তখন আক্রমণ করে খাইরাই দখল করা সম্ভব ছিলনা। তাই ডিশকিবাড়ি ভেদেরগাঁও এলাকায় আমার একটা কোম্পানী ছিল, রাতে তাদের মুভ করিয়ে দিলাম, ওরা রাতারাতি খাইরাইর পেছনে এসে গেল। তখন রাত সাড়ে চারটা (৬ তারিখ)- খাইরাইর ওপর ফায়ার করলো। এটা ঠিক আক্রমণ নয়, এটা হচ্ছে পলায়নপর সৈনিকদের মনোবল ভেঙ্গে দেবার এক কৌশল।

 পাকসেনারা তখন সালুটিকর থেকে আর্টিলারী সাপোর্ট চাইলো, প্রায় পাঁচটার দিকে আর্টিলারী শেল এসে পড়তে শুরু করলো, খাইরাইর আগে এবং চারদিক সার্কেল করে। এই সেলের কভারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী উইথড্র করতে শুরু করলো। আমাদের সামনের ও পেছনের গোলাগুলিতে ওদের সর্বমোট পঁচিশজন মারা গিয়েছিল। আমরা কয়েকটা লাশ পেয়েছিলাম। ভোর ছ'টায় আমি খাইরাইর পাকসেনাদের ডিফেন্সে উঠে যাই। আমার আটটা ক্যাজুয়েলিটি হয়-দু'জন সিভিলিয়ানও মারা যায়। পাকসেনাদের ডিফেন্সে প্রায় ছ'হাজার এম্যুনিশন, ছ'টা রাইফেল, ফিল্ড টেলিফোন এবং প্রচুর পরিমাণ মেশিন ও আর কিছু মর্টারের রাউও পেলাম।

 সকাল আটটায় রওনা হলাম। তোয়াকিবাজারে কোম্পানী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে এডভান্স করলাম পাইকরাজ, জাঙ্গাইলের দিকে। পাইকরাজ ও জাঙ্গাইলের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শত্রুরা আমাদের ওপর গুলি চালালো। আমরা তৎক্ষণাৎ ওখানে হল্ট করে গেলাম- শত্রুকে সামনাসামনি রেখে জমির নালায় পজিশন নিয়ে গুলি বিনিময় শুরু করলাম বিকেল প্রায় ৪টা পর্যন্ত। সাড়ে চারটার দিকে আমরা চার্জ করে শত্রুর বাঙ্কারে উঠে গেলাম। সেখানে রাজাকারও ছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের ধরা হল এবং ওরা মারা যাবার আগে ওদের খবর পেলাম ওদের তেরোজন ও রাজাকার দশজন মারা গেছে।

 সামনে এগোনো শুরু হলো আবার। দশই ডিসেম্বরের মধ্যে পুনাছাগাঁও, বীরকুলি এবং নোয়াগাঁওয়ের শত্রুর অবস্থান মুক্ত করে আঙ্গারজোরে আমার হেডকোয়ার্টার করলাম। বি-এস-এফের মেজর রাও এলেন আমার