পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
7

দিয়ে কি করে আরো বেশী লোক গড়ে তোলা যায়। প্রয়োজনীয় সকল প্রকার দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ এবং ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদেরকে পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হতো। এ ব্যাপারে আমাদের সংগে সব সময় যোগাযোগ রাখার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার তাদের কয়েকজন সিনিয়র সামরিক অফিসারকে নিয়োগ করেন। ব্রিগেডিয়ার র‍্যাংকের এইসব অফিসার ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমাণ্ডের সামরিক এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতেন। তাদের নিযুক্তি ছিলো ভারতীয় সেক্টর কমাণ্ডার হিসাবে। ভারতের একজন সেক্টর কমাণ্ডার বাংলাদেশের দুই অথবা তিনটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানতঃ ভারতীয় সেক্টর কমাণ্ডারদের মাধ্যমেই বআংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার এবং ইস্টার্ন কমাণ্ডের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। যুদ্ধের যাবতীয় নীতিমালা আমাদের হেডকোয়ার্টার এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমাণ্ড যৌথভাবে প্রণয়ন করতেন। এই সকল নীতি কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হতো ভারতীয় এবং বাংলাদেশ সেক্টর কমাণ্ডারদের হাতে। অনেক সময় পরস্পরবিরোধী একাধিক নির্দেশও আসতো। তখন আমরা পড়তাম বিপাকে, কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো।

 ১৫ই জুলাই আমরা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এই বৈঠকে মিলিত হই। এ অনুষ্ঠানে অবশ্য কোন মত বিনিময় কিংবা বিভিন্ন সেক্টরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন আলোচনা হয়নি। সে রাতে সেটি ছিলো শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করি।

 কলকাতা ত্যাগের পূর্বেই জানতে পারলাম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন বাঙালী সামরিক অফিসার পালিয়ে আসতে পেরেছেন। এইসব অফিসারের কাছেই জানা গেলো যে, অন্যান্য বাঙালী অফিসারও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে পালানোর চেস্টা করছেন। কিন্তু এই পালানো চেষ্টা, অর্থাৎ পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসা এবং তারপর যুদ্ধে যোগ দেয়া খুবই বিপজ্জনক ছিলো- বিশেষ করে পাকিস্তানে যারা পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন তাদের জন্যে তো বটেই। পাকিস্তান থেকে আমাদের অফিসাররা চলে আসছেন এ খবরে আমরা খুবই খুশী হয়েছিলাম। আবার অন্য কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিলো। আমাদের যুব শিবির থেকেও ও সময় কিছু লোক পালিয়ে যায়। হয়তো যুব শিবিরের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিংবা ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা এ কাজ করেছিলো। তবে এদের সংখ্যা ছিলো নগণ্য। এই ঘটনা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সমস্যারও সৃষ্টি করেনি।

 যুব শিবিরে কিছু লোকের মধ্যে হতাশ ছিলো এ কথা সত্য। জুলাইয়ের শেষ দিকে মেজর খালেদ মোশাররফ এবং আমি আগরতলার কাছে এই ধরনের একটি শিবির দেখতে যাই। সেখানে তিন হাজার যুবক দু'মাসেরও বেশী সময় ধরে ট্রেনিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো। স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাবস্থা ছিলো খুবই দুঃখজনক। খাদ্য ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই চললেই চলে। অন্যান্য যুব শিবিরেরও একই হাল। লক্ষ্যহীন সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি লোকের পক্ষে হতাশ হয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। যুব শিবিরের সংখ্যা পরের দিকে প্রায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও এতো বিপুলসংখ্যক যুবকের জন্য সকল ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা দুরূহ হয়ে পড়েছিলো।

 আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না- শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী খুব কম লোকের মধ্যেই ট্রেনিং গ্রহণের কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যেতো। যুদ্ধকালে এক লাখেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেয়। কিন্তু এর মধ্যে শতকরা এক ভাগও শরণার্থী শিবিরের লোক ছিলো না। এর কারণ সম্ভবতঃ যুব শিবিরগুলোতে যারা এসেছিলো তারা তাদের পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে ফেলে এসেছিল, তাই ট্রেনিংয়ের পরই তারা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ছিলো উদগ্রীব। তাদের স্বদেশ ত্যাগের একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিলো সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করা। অন্যদিকে বাড়িঘর থেকে পলিয়ে যুব শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো তারা পরিবার-পরিজন সহই সেখানে থাকতো। জীবন বাঁচানোর জন্য অন্ততঃ দু'বেলা দু'মুঠো আহার জুটবে এই নিশ্চয়তাও শিবিরে তাদের ছিলো। বাংলাদেশে তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করার মতো খুব বেশী কেউ ছিলো না। শিবিরে তাদের জীবনের