পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
304

বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের (বর্তমান মেজর) উপর ন্যস্ত ছিল সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর। তাঁর নিয়ন্ত্রণে কিছু নিয়মিত ও ই পি আর বাহিনীর সৈন্য ছিল। সাহেবগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ অনেক আগেই শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাটগ্রাম সাব-সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের উপর। তিনি অনেক স্থান শত্রুমুক্ত করে রেখেছিলেন। দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া সাব-সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল স্কোয়াড্রন লীডার সদরুদ্দীনের (বর্তমান উইং কমাণ্ডার) উপর। এখানেও অনেক এলাকা মুক্ত ছিল।

 মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সেক্টর ৬-এর বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি, কোটগাছ, হিমকুমারী শীতলকুচি, গিতলদহ, সোনাহাট প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। সেই সময়ে সামরিক অফিসারের অভাবে ঠাকুরবাড়ি এবং কোটগাছ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছিল না। সেক্টর কমাণ্ডার বাশার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাকুরবাড়ি এবং কোডগাছ ক্যাম্প পরিচালনার ভার দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশমত ঠাকুরবাড়ি ও কোটগাছ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে থাকি। শত শত শিক্ষিত ও অশিক্ষত যুবককে সামরিক ট্রেনিং দিতে থাকি। এরা প্রায় সকলেই সামরিক ট্রেনিং-এ অনভিজ্ঞ ছিল। সহযেই বুঝতে পারা যায় যে অনভিজ্ঞ যুবকদের কত কষ্টে সামরিক শিক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার অধীনে শিক্ষা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ট্রেনিং ও জ্ঞান অর্জনে যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। তারা কোনদিন কোন অসুবিধার কথা আমাকে জানায়নি। তাদের যাকে যা কাজ দেওয়া হত তারা তা ভালভাবেই সম্পন্ন বা কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হত। সেই জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে পাঠাবার পূর্বে সেই স্থান ভালভাবে রেকী করা হত এবং আমি নিজেই অনেক স্থান রেকী করে তাদের পাঠিয়েছি।

 প্রথমে আমি যেসব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাই সে এলাকাগুলো হল দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গি, রুহিয়া, লেহেরী এবং আটাওয়ারী। এসব এলাকায আমিই রেকী পরিচালনা করেছিলাম। রেকী করা কালে অনেক সময় ইপিকাফ, রাজাকার এবং পাকিস্তানী রেঞ্জারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলাম। এই রকম একটি ঘটনা ঘটে ৫ই সেপ্টেম্বরে। রেকী করার জন্য যাই। আমার সাথে ১২/১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আর সঙ্গে ২টা এল এম জি, একটি ২ ইঞ্চি মর্টার, স্টেনগান ও ৩০৩ রাইফেল ছিল। একটি স্কুলে পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। সেখানে পাকসেনাদের ২টা প্লাটুন ছাড়াও ইপিকাফ ও বিহারী রাজাকারও ছিল। আমাদের রেকী করার খবর কিছু দালাল পাকসেনাদের জানায়। আমি সাধারণত গেরিলা যুদ্ধ চালাতাম। শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমণ করে দ্রুত সরে পড়াই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। তিন ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার পর আমি আমার দল নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। এ যুদ্ধে আমার ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই ঘটনার পর আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের ভিতরে অনুপ্রবেশ করানোর জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী কয়েক স্থানে বেইস স্থাপন করি। পরে এই স্থানগুলি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করানো হয়। ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিষ্ঠিত বেইস দিয়ে ঠাকুরগাঁও, রানীসংকৈল, বোদা, পঁচাগড় ইত্যাদি স্থানে পাঠানো হয়। এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার বাশার আমাকে রংপুরের গীতলদহ ও শীতলকুচিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিতে নির্দেশ দেন। তখন পর্যন্ত এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। গীতলদহ ক্যাম্পে ২ হাজার এবং শীতলকুচি ক্যাম্পে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিচ্ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপঃ

 (ক) ট্রেনিং থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রহণ করা।

 (খ) মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করা। তাদের এ্যামবুশ, রেইড, আক্রমণ, রেল ও সড়ক সেতু (যেগুলি শত্রুদের যাতায়াতে সাহায্য করত) উড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান।