পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
8

ভয়ও কম ছিলো। এসব কারণেই অন্ততঃ সেই মুহূর্তে দেশে ফেরার তেমন আগ্রহ তাদের ছিলো না। তাদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা কারা করছে, কিভাবে করছে, এ নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যাথা ছিলো না। মনে মনে তারা চাইতো কষ্টের কাজটুকু অন্যে করুক, তারা একদিন ধীরেসুস্থে ফিরতে পারলেই হলো। শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে এবং নিছক ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিলো তাদের মধ্যে এই মনেবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। যুদ্ধে তাদের বিশেষ কোন আবদার ছিল না, কিছু থাকলে তা ছিলো পরিসিস্থিতিসাপেক্ষ, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়। এদিকে শত ভয়-ভীতি এবং দারুণ বিপদের মধ্যেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী দেশেই থেকে গিয়েছিলো, স্বাধীনতার জন্য তাদেরকেই দিতে হয়েছে সবচাইতে বেশী মূল্য।

যুদ্ধের পরিবর্তিত গতি

 জুন মাসের শেষদিকে বাংলাদেশের স্বধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। এই সময়ে প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতি এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ বাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হয়। বস্তুতঃ জুনের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও বিভিন্ন সেক্টরের তৎপরতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে জুলাই মাসে আমরা এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলাম। এই সম্মেলনের কথা আগেই বলেছি। ১৫ই মে পর্যন্ত আরা যা কিছু সাহায্য পেয়েছিলাম তার ব্যাবস্থা করেছিলো ভারতীয় বিএসএফ। যাহোক, সময়ের বিবর্তনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দু'টি নতুন ডিভিশনকে বাংলাদেশে এনে মোতায়েন করারপর পুরো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই কারণে সবকিছুতে ভিন্নতর সমন্বয়, প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি এবং ব্যাপক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এই প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য বিএসএফ-এর ছিলো না। তাই ১৯৭১-এর ১৬ই মে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিএসএফ-এর কাছ থেকে বাংলাদেশের অস্বাভাবিক ঘটনাবলী মোকাবিলার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

 লক্ষ্য করার বিষয় যে, বিভিন্ন পাকিস্তনী ডিভিশনের আক্রমণকারী দলগুলো ২৫শে মার্চ রাতে আকস্মিক সশস্ত্র আক্রমণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্নস্থানে অবস্থান গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করে। চলাচলের কাজ বিমানযোগে সম্পন্ন করা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব বিবেচনা করে (১২০০ মাইল ভারতীয় এলাকা) এবং ভারতের ওপর দিয়ে সকল প্রকার পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের পুরো দুটি আর্মি ডিভিশনকে পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তর করতে অন্ততঃ এক মাসের কম সময় লাগার কথা নয়। এই হিসাবে দেখা যায় যে, এক মাস আগে অর্থাৎ ৭১-এর ২৮শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু না করলে দুই ডিভিশন পাকসেনা ২৮শে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে আসতে পারতো না। বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব আর্মি ডিভিশন এখানে এনে মোতায়ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। সবকিছুর তোড়জোড় শুরু হয়েছিলো ২৮শে ফেব্রুয়ারীর আগেই। তা হলে দেখা যায়, ভুট্টো ১৬ই ফেব্রুয়ারী যে হুমকি দিয়েছিলেন তার সাথে এই ষড়যন্ত্রের নিশ্চয়ই একটা যোগসাজশ ছিলো। ভুট্টো বলেছিলেনঃ”কেউ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা যেতে চাইলে তাকে নিজ দায়িত্বেই যেতে হবে, তা তিনি খাকী পোশাকে অথবা সাদা কালো যে পোশাকেই যান না কেন।” রাওয়ালপিণ্ডির আর্মি হেডকোয়ার্টারে ২২শে ফেব্রুয়ারী যে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন হয়, সম্ভবত সেখানেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে।

 ৯ম ডিভিশনের ৩১৩ ব্রিগেডকে বিমানযোগে সিলেট পাঠানো হয়। ১১৭ ব্রিগেড যায় কুমিল্লায়। ১৪ ডিভিশনের অধীনে কুমিল্লায় যে ৫৩ ব্রিগেড অবস্থান করছিলো ইতিমধ্যেই তাকে চট্টগ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ৯ম ডিভিশনের বাংলাদেশে আসার পরই মেঘনার পূর্বদিকের সমগ্র এলাকা অর্থাৎ সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে ৫৩ ব্রিগেড চট্টগ্রাম, ১১৭ ব্রিগেড কুমিল্লায় এবং ৩১৩ ব্রিগেড সিলেটে অবস্থান গ্রহণ করে। আগে থেকেই পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন ১৪ ডিভিশনের ওপর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, প্রভৃতি জেলার দায়িত্ব ছিলো। ৫৩ ব্রিগেডকে ৯ম ডিভিশনের অধীনে এবং ৯ম ডিভিশনের ২৭ ব্রিগেডকে ১৪শ ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত