পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
305

 (গ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য বিষয়ে জানানো।

 (ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার জনগণের সাথে মিশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে জানানোর ব্যবস্থা করা,

 (ঙ) সর্বোপরি পাকসেনাদের অধিকৃত এলাকার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করা।

 আমি এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিয়ে প্রথমে তাদের পরীক্ষা করে দেখি। তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে কিছু জানা নাই এবং সামরিক কৌশল সম্বন্ধে ধারণা নাই। সামরিক অফিসারের অভাব থাকার জন্যই তাদের পক্ষে সামরিক কৌশল জানা সম্ভব হয়নি। সেই জন্য ক্যাম্প দুটির মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকমত পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। আমি তাদের সুস্পষ্টভাবে সামরিক কৌশল শিখিয়ে অপারেশনে পাঠানোর জন্য তৈরী করি। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে বিভক্ত করি। তাদের সংগঠিত করে পাকসেনাদের উপর দিনে কমপক্ষে পাঁচবার হামলা করতে থাকি। এর ফলে তারা এত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে পাকসেনারা দিনেও বাংকার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করত না। আমি অনেক অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যেতাম এবং এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে তুলি। আমার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আমার নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা চালায়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের এ্যামবুশ ও রেইড করা এবং রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেই। তাদেরকে অধিকৃত অঞ্চলে বেইস গড়ে তোলার জন্য নির্দেশ দেই। অনেককে ভেতরে পাঠিয়ে দেই পাকসেনাদের এ্যামবুশ ও রেইড করে পর্যুদস্ত করার জন্য।

 যেসব মুক্তিযোদ্ধা নতুন ট্রেনিং নিয়ে আসত, তাদেরকে প্রথমে শত্রুদের বিরুদ্ধে এ্যামবুশ ও রেইড করার নির্দেশ দিতাম। রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধার সৃষ্টি করার জন্য পাঠাতাম। ছোটখাটো অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী করে তোলা হত।

 একটি অপারেশনের কথা আমার মনে পড়ছে। লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটে অবস্থানরত পাকসেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে রসদ ও সৈন্য আসত। এই সাব সেক্টরের দায়িত্ব ছিল অসমসাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উপর। তিনি আমাকে এই অপারেশন পরিচালনার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি পিছনে অবস্থানরত প্লাটুনের সাহায্যে শত্রুট্রেনের উপর মর্টার চালাবার নির্দেশ দেন। দিনটি ছিল যতদূর সম্ভব ৬ই সেপ্টেম্বর। ভোর ৫টার সময় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোগলহাট রেললাইনের নিকট অবস্থান নেই। রেললাইনের উপর এ্যাণ্টি ট্যাংক মাইন বসানো হয়। গ্যালাটিন ও পি-ই-কে ঠিকমত বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে শত্রু ট্রেন আসার অপেক্ষায় অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিক সময়মত ট্রেনটি সামনের কয়েকটি বগীতে বালি এবং অন্যান্য জিনিস ভর্তি করে পিছনের বগীগুলিতে আসে। আমাদের এ্যাণ্টি-ট্রাঙ্ক মাইনের আঘাতে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগী বিধ্বস্ত হয়। পাক-সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের গোলাগুলির জবাব দিতে শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে নেমে তিনদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের আমি পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দেই। আমার কাছে ১টা হালকা মেশিনগান ছিল। সেই মারণাস্ত্র দিয়ে আমি শত্রুসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাই এবং এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পিছনে সরে যেতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে ২ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমিও বাঁ হাতে সামান্য আঘাত পাই। শত্রুদের ৫ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এই অপারেশন পরিচালনার জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। এই অপারেশনের খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। এ ছাড়া আমি যেসব অপারেশনে অংশগ্রহণ করি সেগুলো হলঃ মোগলহাট পাক অবস্থানের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ, নাগেশ্বরী পাক-কোম্পানী হেডকোয়ার্টার আক্রমণ, কম্বলপুর ব্রীজ অপারেশন, কুলাঘাট শত্রু অবস্থানের উপর হামলা, দোরাকুটি পাক অবস্থানের উপর হামলা, নুমেরী পাক