পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
306

অবস্থানে আক্রমণ, পাটেশ্বরী শত্রু গোলন্দাজ অবস্থানের উপর হামলা, ভাতমারী শত্রু কোম্পানী অবস্থানের উপর হামলা, কালীগঞ্জ পাক-অবস্তান আক্রমণ, তুষভাণ্ডা শত্রু প্লাটুনের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ, হাতিবান্ধা শত্রু কোম্পানীর উপর আক্রমণ ইত্যাদি।

 বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী থানাগুলিতে আক্রমণ চালানোর জন্য আমি কয়েকটা বেইস গড়ে তুলি। ফুলবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। লালমনিরহাট থানার ইমানগঞ্জ হাট ও কর্নারহাট এলাকায় আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। কালীগঞ্জ থানায় দাইখোয়া ও চালতায় বেইস গড়ে তোলা হয়। এসব স্থান তেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বিভিন্ন পাক অবস্তানের উপর এ্যামবুশ ও রেইড করত। তারা রেল ও সড়কসেতু উড়িয়ে দিয়ে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধার সৃষ্টি করত।

 এসব সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করার পর রংপুর জেলার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে অনুপ্রবেশ করানো যায়, সে চিন্তা করতে থাকি। সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিসাধন করতে থাকে। পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এমনকি দিনের বেলাতেও পাকসেনারা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করত না। পাক-সেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। আমাদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবার ফলে পাকসেনারা গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর পূর্বে পাকসেনারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ, নারীধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া এবং গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাত। আমাদের কার্যকলাপের ফলে গ্রামবাসীরা অনেক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা আমাদের শত্রুপক্ষের অনেক গোপন তথ্য জানিয়ে সাহায্য করত। আমার পক্ষে সব বেইস এলাকায় থাকা সম্ভব ছিল না। তাই মাঝে-মধ্যে প্রায় সব ক'টি বেইস এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে অনেক অপারেশনে অংশগ্রহন করতাম। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। আমি ভিতরে অনেক লোককে নিয়োগ করি শত্রুপক্ষের গোপন তথ্যাদি ও গতিবিধি সম্বন্ধে খবর দেবার জন্য। তারা আমাকে ঠিকমত খবরাখবর দিয়ে অপারেশনে সাহায্য করত।

 মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি রাতেই তাদের অবস্থান বদল করত। এক স্থানে অবস্থান নিয়ে বসে থাকত না। আমি নিম্নলিখিত এলাকায় বেইস তৈরী করি। এগুলো হলঃ লালমনিরহাট থানার কস্তুরীহাট, কাউনিয়া থানার তেপাহাটা, গংগাচরা থানার গংগাচরা, লালমনিরহাট থানার শিবরাম ও পাঁচ গ্রাম কাউনিয়া থানার সারাই ও নাজিরদহ, পীরগাছা থানার জিগাবড়ি ও বাজে মশকুর, কাউনিয়া থানার তেপামধুপুর, মিঠাপুকুর থানার রাজপুকুর, জলঢাকা থানার খৈলমারী ইত্যাদি।

 এসব এলাকায় বেইস তৈরী করার পর আমি প্রতি এলাকর জন্য ১০ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার পার্টি নিয়োগ করি শত্রুদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য। তিনদিন অন্তর তাদের প্রত্যেক পার্টিকে ভাগাভাগি করে অপারেশনের দায়িত্ব দিতাম। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় সব কটি বেইস এলাকায় তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। অক্টোবর মাসের শেষদিকে প্রায় প্রতি বেইসে ১৫০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ করতে সক্ষম হই। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৭০ মাইল ভিতরেও বেইস তৈরী করতে সক্ষম হই। এক বেইস এলাকার সাথে অন্য বেইস এলাকার যোগাযোগ রাখা হত। এইভাবে তারা এক অন্যের সাহায্য করে এবং আমার সাথে চেইন হিসেবে যোগাযোগ রাখে। প্রতি বেইস এলাকা থেকেই তারা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাত। আমি কোম্পানী কমাণ্ডারদের কাছে নির্দেশ পাঠাতাম এবং সপ্তাহ অন্তর কোম্পানী কমাণ্ডাররা তাদের রিপোর্ট পাঠাত। দূরবর্তী কোম্পানী কমাণ্ডারদের এক সপ্তাহের কাজ দিতাম। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল শত্রুদের সামনে থেকে আক্রমণ না করে এ্যামবুশ ও রেইড করে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য এবং যোগাযোগ ও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়ার জন্য, সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস ও উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আরও নির্দেশ ছিল গ্রামবাসী ও এলাকাবাসীদের সাথে মিশে তাদের সাহায্য নিয়ে অপারেশন করার জন্য। কিন্তু আবার এই সময় রাজকার, আলবদর, আল-শামস, মুসলীম লীগ ও জামায়াতে