পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
313

১২ই ডিসেম্বর আমরা দিনের বেলায় খানসামা আক্রমণ করি। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীও ছিল। এই আক্রমণে ভারতীয় বাহিনীর ১৫ জনের মত ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবং আমাদের ৭ জন মারা যায়। এখানে আমরা মেজর খুরশিদসহ ১৯ জনকে জীবন্ত ধরে ফেলি। ঐ দিনই আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হই এবং নীলফামারী দখল করে ফেলি।

 ১৩ তারিখে আমরা সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হই। সৈয়দপুর থেকে ৫ মাইল দূরে পাক ট্যাঙ্কের সহিত আমাদের ট্যাঙ্কের সংঘর্ষ হয়। তাতে ভারতীয় বাহিনীর দুটি ট্যাঙ্ক ও পাকবাহিনীর তিনটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ১৩ তারিখ বিকালে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অধিনায়ক ও একজন অফিসারসহ প্রায় ১০৭ জন পাকসৈন্য আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

 ১৫ই ডিসেম্বর রাতে পাক ব্রিগেড কমাণ্ডার সাইফুল্লাহ যুদ্ধ স্থগিত রাখবার জন্য অনুরোধ করেন। কিছুক্ষন পর তিনি কয়েজন গার্ডসহ আমাদের সম্মিলিত ক্যাম্পে আসেন। তার সঙ্গে আমাদের অনেক সময় ধরে আলাপ-আলোচনা হয়। পরে পাক ব্রিগেড কমাণ্ডার চলে যান।

 ১৭ তারিখ সকালে সেখানে অবস্থানরত সকল পাকসৈন্য মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

স্বাক্ষরঃ মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশীদ
কুমিল্লা সেনানিবাস
১৪-১০-৭৩

সাক্ষাৎকারঃ সৈয়দ মনসুর আলী

 ১৯৭১-এর ২রা নভেম্বর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব আমাকে মুক্তিবাহনীর দুটি এলাকার (বুড়াবুড়ি এবং যাত্রাপুর) কোম্পানী কমাণ্ডার করে পাঠান। প্রথমে নগেশ্বরী থানার মাদারগঞ্জে করা হয় ক্যাম্প এবং সেখান থেকে যাত্রাপুর অপারেশন করা হয়। একদিন যাত্রাপুর বাজারে তিনজন পাকসেনা এবং ৯ জন রাজাকার আসলে তাদের আক্রমণ করি এবং ৩ জন পাকসেনা এবং ৯ জন রাজাকার সংঘর্ষে নিহত হয়। জনগণের সহায়তায় ১৫০ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করা হয় (৯ই নভেম্বর, ১৯৭১)। ৯ই নভেম্বর স্বাধীন বাংলায় প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সংঘর্ষের খবর পেয়ে কুড়িগ্রাম থানায় ঘোগাদেহ ইউনিয়নের ৩০০ রাজাকার স্বেচ্ছায় তাদের হাতিয়ারসহ যাত্রাপুরে আমার নিকট আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের খবর বিভিন্ন স্থানের রাজাকরাদের মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা কুড়িগ্রাম মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন নুনখাওয়া বুড়াবুড়ি, মোগলবাছা ইত্যাদি ইউনিয়ন থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কুড়িগ্রাম শহরের পাকসৈন্যের ঘাঁটি থেকে বহু রাজাকার তাদের হাতিয়ারসহ পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

 কুড়িগ্রাম শহরের নিকটবর্তী মোগলবাছা ইউনিয়নে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি ছিল আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনবার পাক ঘাঁটি আক্রমণ করি। তৃতীয়বারের সংঘর্ষে উনিপুরগামী ট্রেনের দুটি বর্গী বিচ্ছিন্ন করি ডিনামাইট দিয়ে। এত প্রায় ৩৫ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। মোগলবাছা ইউনিয়নের অর্জুনমালায় রেলসেতুর লাইনের নীচে ডিনামাইট রাখা হয়েছিল। পাকবাহিনীর ট্রেন অতিক্রমের সময় ডিনামাইটটি বিস্ফোরিত হয়। কার্যরত সময়ে বিস্ফোরণে মীর নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়।

 ৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যোশীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে বর্বর পাক বাহিনীর অবস্থানে ভারী ও দূরপাল্লার কামান দিয়ে আক্রমণ করে। পাক বাহিনী তেমন মোকাবিলা না করেই কুড়িগ্রাম থেকে সরে পড়ে।