পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
320

 ২৫শে আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লীডার সিপাহী মকবুল হোসেনকে (ইপকাপ নং ২৯১২৭) কুড়িগ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে প্রতাপ গ্রামে ছদ্মবেশে তৎপর থাকাকালীন আমাদের গেরিলারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লীডার মকবুল নারীর ছদ্মবেশে উক্ত গ্রামে খবর সংগ্রহের জন্য ঘোরাফেরা করছিল।

 ৬ই নভেম্বর প্রত্যুষে প্রায় আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধা এম এফ/এফ-এফ ৪ থেকে ৫ ব্যাটেলিয়ান ভারতীয় সৈন্যদের সহযোগিতায় ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাটে (মহাযুদ্ধকালীন বৃটিশরাজ নির্মিত রেলওয়ে স্টেশন) পাকিস্তানী সৈন্যদের শক্তিশালী অবস্থান ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে দখল করে নেয়। এই প্রচণ্ড সংঘর্ষে বহুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানীদের বিপুলসংখ্যক আধুনিক মারণাস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী হস্তগত করে। ভারতীয় বাহিনীর কিছুসংখ্যক জোয়ান সংঘর্ষকালীন নিহত হয়। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের এম-এফ/এফ-এফ'দের মধ্যে মাত্র কয়েকজন নিহত হন।

 ১৩ই নভেম্বর ভূরুঙ্গামারী থানার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এইদিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সহায়ক সৈন্যদের সম্মিলিত বিরাট বাহিনীর বীরযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের দখল থেকে ভূরুঙ্গামারী মুক্তি করেন। এই অভিযানে ভারতীয় সহায়ক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার যোশী এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিচালনা করেন সাবেক বিমান বাহিনীর উইং কমাণ্ডার ও যুদ্ধকালীন সেক্টর কমাণ্ডার কে, এম, বাশার ও সাব-সেক্টর কমাণ্ডার মেজর নওয়াজেশ। ১৩ই নভেম্বরের এই সম্মিলিত আক্রমণে ৩ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে জীবন্ত ধরা হয়। কোন পথেই পাকিস্তানীরা পালাতে না পেরে বহু মারা পড়ে। সৈন্যদের পরিত্যক্ত বিপুল সমরসম্ভার সম্মিলিত বাহিনীর হস্তগত হয়। ভূরুঙ্গামারী দখলের পরপরই বেশ কিছুসংখ্যক বাঙ্গালী শিক্ষিতা মহিলাকে স্থানীয় সার্কেল অফিসার উন্নয়ন অফিসে বন্দী অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মহিলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বর্বর সৈন্যরা এদেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ করে এখানে এনে রেখেছিল।

 ২২শে নভেম্বর রংপুর জেলার অন্তর্গত বড়খাতায় হানাদার বাহিনীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে কোম্পানী কমাণ্ডার মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান (নং ০৫৯৩) শহীদ হন। এছাড়া আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা সংঘর্ষকালে শহীদ হন। সংঘর্ষে পাকিস্তানীরা গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেনঃ হাবিলদার রঙ্গু মিয়া (নং ৭০২১২৪৭) ও এম-এফ নাসির আহমেদ। (এম-এফ নাসির আহমদ ঐ সময় মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন)।

 ২০শে নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র লেঃ সামাদ কুড়িগ্রাম মহকুমার অন্তর্গত রায়গঞ্জ সি এণ্ড বি পুলের দুই পার্শ্বে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালান। তাঁকে ভারতীয় সহায়ক বাহিনী দিয়ে সাহায্য করে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার যোশী। প্রচণ্ড সংঘর্ষে এক পর্যায়ে যখন হানাদার সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতাহাতি সংঘর্ষ শুরু হয় তখন দুঃসাহসী সামাদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিচালনা করছিলেন বীরবিক্রমে। হঠাৎ হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে তিনি আহত হয়ে সংঘর্ষে ক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত অপর মুক্তিযোদ্ধা হলেন ই-পি-আর সিপাহী কবীর আহমদ (৫০১৬৫) এবং আবদুল আজিজ। তীব্র মুখোমুখি যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাগণ শত্রুদের রায়গঞ্জ ও আন্ধারীঝাড় অবস্থান দখল করেন। বহুসংখ্যক পাকিস্থানী সৈন্য হতাহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আসে।

 ২৪শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নাগেশ্বরী থানাও পাটেশ্বরীতে অবস্থানরত সৈন্যদের ঘেরাও করে। ঐ দিনের সংঘর্ষে সাইদুর রহমান এফ-এফ ৯০/৩৫, সেরাজুল হক এফ-এফ ১১৮/২০ এবং সোহরাব আলী এফ-এফ ১১৮/৩৬ নিহত হন।