পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
322

ক্রস করে চলে যায়। ফলে তাকে এ্যামবুশ করা সেদিনের মত হয়নি। কিন্তু তাকে ধরবার জন্য খোলা মাঠের উপর দিয়ে আমরা পিছনে পিছনে দৌড়ে যাই, হঠাৎ দেখি সামনে সাদা বিল্ডিং। আমি শুনেছিলাম যে, ভূরুঙ্গামারী কলেজে পাকিস্তান আর্মি থাকে। ভূরুঙ্গামারীর একমাত্র সাদা বিল্ডিং হচ্ছে ঐ ভুরুঙ্গামারী কলেজ। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে ঐ সাদা বিল্ডিং-এর প্রায় ৩০ গজ দূরে চলে গিয়েছিলাম। যখন বাঁশঝাড় থেকে বের হই তখনই দেখি সাদা বিল্ডিং এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা থেমে যাই। আবার বাঁশ ঝাড়ের ভিতর চলে যাই। কেননা, এখানেই পাকিস্তান আর্মি থাকে। আমরা তখন ওদের কথাবার্তা শুনছি। বাঁশঝাড় থেকে কলেজ খুব বেশী হলে ৫০ গজ। সামনে ছোট ছোট পাটগাছ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চাঁদ ছিল, তাই পরিষ্কার সবকিছু দেখা যায়। কলেজের পাশ দিয়ে পাকিস্তানী সেণ্ট্রীগুলো হাঁটছে, আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ইণ্ডিয়ান ব্রিগেডিয়ার যে কমেণ্ট করেছিলো সেটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমার মাথায় চিন্তা ছিল কিছু একটা করতে হবে। সেজন্য আমি অপেক্ষা করতে থাকি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন বৃষ্টি আসে। অন্ততঃ মেঘ আসুক যাতে চাঁদ না থাকে, অন্ধকার হয়ে যায়। এ রকম অপেক্ষা করতে করতে রাত যখন দেড়টা-দুইটা তখন ঠিকই মেঘ আসলো এবং ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। রাত সাড়ে দশটার দিকে পাকিস্তানী আর্মি দিনের ডিউটি শেষ করে ঘুমাতে যায়, সেণ্ট্রী বাদে। আমরা সেনট্রীদের দেখতে পাচ্ছিলাম। হাঁটাচলা করছে। আমি এবং আমার ব্যাটম্যানের হাতে দুটা করে গ্রেনেড। আমাদের সাথে যে আরেকটি লোক ছিল ও হাতে এল-এম-জি ছিল। তাকে আমরা পাশে রেখেছিলাম। তাকে অর্ডার দিয়েছিলাম যে, গ্রেনেডের চারটা এক্সপ্লোশন হওয়ার পরে সে ফায়ার করতে থাকবে যেন আমরা উইথড্র করতে পারি। বৃষ্টির ভিতর আমরা পাটক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রস করতে করতে বিল্ডিং-এর কাছে পৌছাই এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি বিল্ডিং-এর বারান্দায় চৌকীর উপরে পাকিস্তানী আর্মিরা শুয়ে আছে। পাকিস্তানী সেনট্রীটা যখন হেঁটে আমাদের ক্রস করে চলে যায় তখন আমরা দুজন দৌড়ে আমাদের গ্রেনেড ফেলে দিয়ে ফেরত চলে আসি। তখনও আমরা জানতাম না পাকিস্তানীদের কি ক্ষয়ক্ষতি হলো। আমরা দৌড়ে ফেরত আসছি, ততক্ষণে পাকিস্তানীরা গুলি করতে শুরু করেছে। হঠাৎ আমি আছাড় খেয়ে পড়ে যাই। মনে হলো আমার পায়ে কিছু একটা লেগেছে। পরে দেখি আমার ডান পাটা অবশ হয়ে গেছে, আমি আর উঠতে পারছি না। আমার ব্যাটম্যান এবং আমার সাথের লোকটি দু'জনে ধরে আমাকে উঠায়। তখন দেখি যে আমার পায়ে একটা গুলি লেগেছে। গুলিটা বেশী ভেদ করে যেতে পারেনি, কেননা আমরা বেশ দূরে ছিলাম ওরা তাড়াতাড়ি ঘাড়ে করে আমাকে নিয়ে আসে। এবং আমরা আবার ইণ্ডিয়াতে ফেরত আসি। সেখানে আমাদের ডাক্তার ছিল, সে গুলি বের করে ব্যাণ্ডেজ করে দেয়। আমি সতিদিন পরেই ঠিক হয়ে যাই। পরে আমরা জানতে পারি যে, সেদিনের গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে ৭ জন পাক আর্মি নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়েছে।

 কয়েকদিন পর ভুরুঙ্গামারীতে দুই কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ করার প্ল্যান করা হয়। খুব সম্ভব জুলাই/আগস্টের দিকে। সেখানে পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল। ঐ জায়গাটা দখল করার জন্য আক্রমণের প্ল্যান করা হয়। ইণ্ডিয়ানরা আমাদের আর্টিলারী সাপোর্ট দেবে। আমরা দুই কোম্পানী সারারাত হাঁটার পরে ভোরবেলা ঐ কলেজের কাছে পৌছাই। ভোর হচ্ছে হচ্ছে এমন সময় জয়বাংলা বলে আক্রমণ করি। মোট দুটি কোম্পানী ছিল। দুটিরই ফিল্ড কমাণ্ডার আমি ছিলাম। কর্নেল নওয়াজেশ অবশ্য কোম্পানী কমাণ্ডারের কাজ করেননি, তিনি ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডারের কাজ করেছেন। তিনি যুদ্ধকে ডাইরেকক্ট করছিলেন। পিছন থেকে। এছাড়াও আরো ৮০জন গিয়েছিল, সেটা লেঃ ফারুকের অধীনে ছিল। তাদের কাজ ছিল নাগেশ্বরী থেকে যে রোড এসেছে ভূরুঙ্গামারীতে সেই রোডের উপর এ্যামবুশ করা, যাতে পাকিস্তানীরা রিইনফোর্সমেণ্ট না আনতে পারে। এজন্য সে প্রায় সাড়ে তিন মাইল দূরে জয়মনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এ্যামবুশ পাতে এবং আমরা ৫০ গজ দূর থেকে জয়বাংলা বলে আক্রমণ শুরু করি। পাকিস্তানীরা প্রথমেই গুলি করে। তাদের সম্মুখে যে বাঙ্কারগুলো ছিল সেগুলো থেকে উইথড্র করে তারা পিছনে সরে যায়। আমাদের লোকেরা সবাই পাকিস্তানীদের গুলি আসার সাথে সাথে মাটিতে শুয়ে পড়ে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাদের মাটি থেকে উঠাতে পারিনি। তবে আমি কিছু লোক নিয়ে কলেজ বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে যাই। ইতিমধ্যে ইণ্ডিয়ানরা যে আমাদের আর্টিলারী সাপোর্ট দিচ্ছিলো সেটা ভুল হওয়াতে আমাদের গোলাই আমাদের উপর এসে পড়তে শুরু করে, যার ফলে আমাদের ৪/৫ জন মারা