পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
324

গ্রামে যদি আর্মিরা না থাকতো তখন আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে বসে থাকতাম। এভাবে এগোতে এগোতে আমরা সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানীদের থেকে ৪০০ গজ দূরে এসে ডিফেন্স নিলাম। মধ্যখানে ধানক্ষেত। এপাশে আমরা, ওপাশে ওরা। সে সময় আমাদের মরাল খুবই ডাউন ছিল। কেননা এ পর্যন্ত আমরা কোন কিছুতেই তেমন সফলকাম হতে পারিনি। পাকিস্তানী ডিফেন্সের বিপরীতেও আমরা আক্রমণ চালাই কিন্তু তাদের ডিফেন্স এত শক্ত ছিল যে, আমার লোকজনের তেমন ভাল ট্রেনিং না থাকায় অনেক সময় আমরা তাদের বাঙ্কারের উপর উঠে বসে থাকতাম। তারা বাঙ্কারের ভিতরে কিন্তু আমরা তাদেরকে মারতে পারতাম না। ফলে আমরা হতাহত হয়ে পিছনে হটতাম। এবং তারা যে মাইন বসাতো তাতে আমাদের অনেক লোক হতাহত হতো। সুতরাং আমি দেখলাম যে এভাবে আমাদের কোন সাকসেস হবে না, অন্যভাবে হয়তো হবে। আমার ডানপাশে ছিল তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর ওপাশে পাকিস্তানীদের অবাধ গতি। রৌমারী থানার অন্তর্গত সুঠিবাড়ী এলাকা বলে একটা জায়গা ছিল। আমরা খবর পেতাম সেখানে পাকিস্তানীদের একটা প্লাটুন আছে এবং সাথে ইপিকাফের আরো একটি প্লাটুন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী নিয়ে ঐ জায়গাটি রেইড করবো। আমার বিশ্বাস ছিল সাফল্য আমাদের আসবে। এবং এ সাফল্যে আমার ট্রুপসের মনোবল বেড়ে যাবে।

 আমি এক কোম্পানী নিয়ে বাওরা থোকে দুটি নৌকাযোগে তিস্তা নদী পার হই। সে রাতে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীর মাঝখানে পৌঁছে মনে হয়েছিল আমারে নৌকা বুঝি ডুবে যাবে এবং আমরা সবাই ডুবে মারা যাব কারণ নদীতে ছিল প্রচণ্ড স্রোত। নদী পার হয়ে গাইডের সাহায্যে আমরা সুঠিবাড়ী- যেখানে একটা বিল্ডিং ছিল, সম্ভবতঃ কৃষি দফতরের ভবন- প্রায় পৌছে যাই। বিল্ডিং-এর সামনে প্রায় ৫০ গজ চওড়া একটা ছোট ক্যানেল ছিল। আমাদের আক্রমণ করতে হলে ক্যানেলটি পার হতে হবে। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। আমি আমার কোম্পানীকে দু'ভাগে ভাগ করলাম। একটি দল ইতিমধ্যে ক্যানেল ক্রস করে রৌমারীর দিকের যে রাস্তা সেই রাস্তায় এ্যামবুশ করে বসেছে। প্ল্যান ছিল আমি আক্রমণ চালালে পাক ফৌজ পালিয়ে যেন রৌমারীর পথে যেতে না পারে। অপরদিকে রৌমারী থেকেও যেন পাকসেনারা সাহায্যে এখানে আসতে না পারে। আমি ক্যানেলটির পার থেকে পাকসেনাদের মুভমেণ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি নিজে ক্যানেল ক্রস করতে পারছিলাম না। দ্রুত সময় পার হচ্ছিলো। ক্রমশঃ আমার মনে দ্বিধা জন্মাচ্ছিলো আক্রমণ করবো কিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমণ করবোই। আমি আমার মর্টার দিয়ে প্রথম ফায়ার ওপেন করলাম। পাকসেনারা কিছুক্ষণ বিচলিত হয়ে পরক্ষণেই পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমি একসময় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার কোমরে দড়ি বাঁধা থাকতো। আমার ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাটম্যানও নদীতে ঝাঁপ দেয়। দড়ির বাকি অংশ তার হাতেই ছিল। ব্যাটম্যান টেনে আমাকে ক্যানেলের অপর পাড়ে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গের সবাই ক্যানেল পার হয়ে বিল্ডিং-এর উপর চড়াও হয়। পাকিস্তানীরা তখন পালাবার চেষ্টা করতে থাকে। এই আক্রমণে ১৫ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। ১৫ জনের ৭ জন ছিল পাক সেনাবাহিনীর এবং ৮ জন ছিল ইপিকাফ। আহত হয় প্রচুর। ঐ সংঘর্ষ আগস্টের শেষের দিকে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘটে। ঠিক তারিখ আজ আর মনে নেই। ভারতীয়রা বলতো প্রমাণ স্বরূপ যুদ্ধে নিহত পাকসেনাদের মাথা কেটে নিয়ে আসতে হবে। আমরা ১৫টি মাথা কেটে এবং তাদের ইউনিফর্ম নিয়ে আমাদের গন্তব্যে রওয়ানা হই। এই সংঘর্ষে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তিনজন গুরুতররূপে আহত হন। এই আক্রমণের জন্যেই পরবর্তীতে আমাকে বীরবিক্রম উপাধি দেয়া হয়। সংঘর্ষে আমার ছেলেদের মনোবল সাংঘাতিকভাবে বেড়ে যায়। পাকসেনারা যখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছিলো, তখন আমার ছেলেরা পিছু ধাওয়া করে তাদের হত্যা করছিলো। আমার ছেলেদের সাহসিকতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম আমি সেদিন। এই অপারেশনে আমার সাব-সেক্টরে ভীষণ মরাল ইফেক্ট হয়েছিল- যার ফলে আমার রেইডিং পার্টি পরবর্তীতে সৈয়দপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে রেইড করতো। এবং প্রতিটি রেইডই সাকসেসফুল হয়েছে।

 বয়রাতে আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা লম্বালম্বি নিয়েছিলাম। আমাদের সামনে ৪০০/৫০০ গজ দূরে পাকসেনারা ডিফেন্সে ছিল। পাকিস্তানীরা প্রায়ই আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ডিফেন্স দখল করার