পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
10

টহল কার্যে নিযুক্ত ছিলো। আমাদের পরিকল্পনা গোপন রাখতে পারলে এসব বাধা তেমন কোন সমস্যাই নয়। ঠিক হলো পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ১৪ই আগস্টের ৬০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত তরুণকে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হবে। রাতে তারা সাঁতার কেটে কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে যত বেশীসংখ্যক জাহাজে গিয়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেবে। তারপর তারা ভাটার টানে দূরে সরে যাবে।

 ১০ই আগস্ট ‘অপারেশন জ্যাকপট' শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বাছাইকৃত ৬০ জন তরুণকে তিন ভাগে ভাগ করি। ১ এবং ২ নম্বর গ্রুপ স্থলপথে মিরেশ্বরাই, সীতাকুণ্ড এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলীর পূর্বপাড় চরলাক্ষার সর্বশেষ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছবে। ৩ নম্বর গ্রুপ চরলাক্ষায় উপনীত হবে নৌকাযোগে। তিনটি গ্রুপেরই সার্বিক কমাণ্ডে থাকবেন একজন কমাগুর। তাদের সকলের কাছে থাকবে লিমপেট মাইন, এক জোড়া ‘ফিন’ (সাঁতারের সময় পায়ে লাগানোর জন্য) এবং শুকনো খাবার। প্রতি তিনজনের কাছে একটি করে স্টেনগান থাকবে। সার্বিক দায়িত্বে নিযুক্ত গ্রুপ কমাণ্ডারকে আরো দেয়া হয় হালকা ধরনের অথচ শক্তিশালী একটি ট্রানজিস্টার সেট। তার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে, অল ইণ্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের প্রতিটি সঙ্গীতানুষ্ঠান তাকে শুনতে হবে খুব মন দিয়ে। এতে ব্যর্থ হলেই সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

 ৯ই আগস্ট হরিণা ক্যাম্পে তাদেরকে চূড়ান্ত নির্দেশ দেই। পথপ্রদর্শক এবং কুলীসহ তাদের সকলকে বলে দেয়া হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কখন কিভাবে অগ্রসর হতে হবে, পথে কোথায় কোথায় থামবে ইত্যাদি। প্রতিটি এলাকায় আমাদের বিশ্বস্ত গেরিলা বেস কমাণ্ডারের ঠিকানা দিয়ে দেয়া হয়, এরা তরুণদের খাদ্য ও আশ্রয় দেবে এবং চরলাক্ষার পথে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। ১৩ই আগস্ট ১ নম্বর এবং ২ নম্বর গ্রুপ চরলাক্ষার পূর্ববর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়। জায়গাটি চট্টগ্রাম শহরের কাছেই। পথে অবশিষ্ট অংশটুকু এদের জন্য খুবই মারাত্মক, কারণ তাদেরকে শহরের ভেতর দিয়ে গিয়ে নৌকায় নদী পার হতে হবে। তারপরই তাদের শেষ ঘাঁটি চরলাক্ষা।

 এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনত দিবসে দখলদার বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনী সাংঘাতিক আক্রমণ চালাবে। এ কারণে শত্রুরা ছিলো পুরো সতর্ক অবস্থায়। সারারাত ধরে কারফিউ চলতো। লোকজনকে তল্লাশীর জন্য পথের মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছিলো অসংখ্য চেকপোস্ট। মেশিনগান ফিট করা আর্মি জীপগুলো সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিলো। নতুন করে আবার বাড়ি বাড়ি তল্লাশী শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও দিয়েও অভিযান চালানো হয়। পথচারী সবাইকে কঠিন তল্লাশী করা হয়। এতসব তল্লাশী ফাঁকি দিয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে পার হতে হবে ১ নম্বর এবং ২ নম্বর গ্রুপকে। তারপর আছে নদী পার হবার সময় আর এক তল্লাশীর ঝামেলা। সেটা পার হলো আশা আছে সময়মত এই দুই গ্রুপ চরলাক্ষায় পৌছে যাবে। কিন্তু কোন কারণে যদি দলের একজনও ধরা পড়ে তাহলে সমস্ত অভিযান বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা। তাই এই হামলাকারী দলের নেতা নিজেও আমাদের মতই চিন্তিত ছিলো।

 আরো একটি কারণে এই দলের নেতা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নৌকায় করে ৩ নম্বর গ্রুপটির ১৩ তারিখে ঘাঁটিতে পৌছার কথা ছিলো, তারা সে ঘাঁটিতে পৌঁছেতে সক্ষম হয়নি। এদিকে ১৩ই আগস্ট কলকাতা রেডিওর সংগীতানুষ্ঠান শোনার জন্য ট্রানজিস্টার খুলতেই তার কানে ভেসে এলো পুরোনো দিনের বাংলা গান “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি”। এই গানের ভেতর দিয়ে সে এবং তার দল প্রথম সংকেত লাভ করে। কমাণ্ডর জানে, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি গান সে শুনতে পাবে। ওটি শোনার পরই সে ট্রানজিস্টার ফেলে দিতে পারবে। 'অপারেশন ক্যাকপট' সফল না হওয়া পর্যন্ত তাদের আর কোন গান শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রেডিও শুনতে হবে না।

 নগরীতে মোতায়েন আমাদের লোকেরা চমৎকারভাবে দায়িত্ব পারল করেছিলো। তারা মিশনের নৌ- মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে একেবারে চরলাক্ষায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়। রাস্তায় একটি এ্যাম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পিকআপ ভ্যান দেখতে পেলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের মনে তেমন সন্দেহ জাগেনি। শুধু