পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
327

ছোটখাটো অনেক অপারেশনে গিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বোয়ালিয়া ব্রীজ অপারেশন। আমরা বড় পুল বলতাম। এখানে রাজাকাররা পাহারায় ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই ব্রীজে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা। আমরা এ পরিকল্পনায় বেরিয়েছিলাম। ঐদিনই সম্ভবতঃ কুড়িগ্রাম থেকে একটা দল ট্রেনে করে তিস্তার দিকে যাচ্ছিলো। এই ব্রীজের আরেকটু দূরে আরেকটা দল বি-ডি-আর এর নায়েক সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। পরে আমরাও যোগ দেই সেই আক্রমণে, এবং আশেপাশের অনেক লোক, আনসারদের মধ্যে যারা ছিল তারা সবাই যোগ দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে হানাদারদেরকে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা সেখানে গিয়ে অনেক রক্তের দাগ দেখতে পাই এবং পরে জেনেছিলাম তাদের অনেক হতাহত হয়েছে। তারপর রেললাইনের নীচু দিয়ে অপর পাশের কভার দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাটা একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

 প্রঃ কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?

 উত্তরঃ এটা 'আনন্দবাজার' পত্রিকায় ছাপা হয়। ঐ সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলা তৎপরতার একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের খবর ছিল এটা।

 দ্বিতীয় ঘটনাটা তবে সম্ভবতঃ জুলাইয়ের শেষের দিকে বা আগস্টের প্রথম দিকে। আমি এই ঘটনায় প্রথমে ছিলাম না, পরে জড়িয়ে পড়ি। ঘটনাটা আমাদেরই এলাকায়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মেয়েলোকের পোশকে ঐ এলাকায় আসে। মকবুল খান তার নাম ছিল। মহিলা সেজে অন্য মেয়েলোক ধরতে অসুবিধা হবে না এই রকম একটা মোটিভ নিয়ে সে এসেছিল। আমরা গ্রামের মধ্যে আর্লি ওয়ানিং‍ সিস্টেম রেখেছিলাম। গ্রামের কোণে কোণে আমাদের যুবকরা পাহারা দিত। গ্রামের মধ্যে কেউ ঢুকলে ওরা তাড়াতাড়ি খবর দিত। একজন এসে বললো যে একটা মেয়েলোক গ্রামের দিকে আসছে, সে দেখতে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের মেয়েলোক সাধারণতঃ এই রকম দীর্ঘকায় মোটাসোটা হয়না। তাই সবার মনেই একটা সন্দেহ হলো। সে গ্রামে ঢুকেছে, মেয়েলোকদের ধরার চেষ্টা করেছে, পারেনি এবং এক জায়গায় একটা মেয়েকে ধরেছিল, সে চীৎকার করে পালিয়ে গেছে। এই খবরটা কিছুদূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এক পর্যায়ে যুবক দলের মধ্যে আবদুর রহমান নামে একটি সাহসী ছেলে লোকটিকে ধরে ফেলে। লোকটির কাছে বোধহয় একটা হুইসেল ছিল অথবা তার ঠোঁট দিয়ে সে খুব জোরে একটা হুইসেল দেয়। হুইসেল দেয়ার ফলে সেই বোয়ালিয় ব্রীজ থেকে গুলি গুরু হয়। সেখানে পোস্ট ছিল। সেখানকার লোক এসে তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ছেলেদের সেই দল মকবুল খানকে ধরে নিয়ে ধরলা নদী পার হয়ে ফুলবাড়িতে চলে আসে। সেদিনই আমরা যাচ্ছিলাম একটা অপারেশনে। ধরলার পারে ওদের দেখা পেলাম। মকবুল খানকে ফুলবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে আসি। পরে তাকে সাহেবগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তার কাছ থেকে অনেক কথা জানা যায়। সে ছিল পাঞ্জাবী। তার উদ্দেশ্য ছিল ঐ একটাই- গ্রামে এসে মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া। এটা একটা চমকপ্রদ ঘটনা বলতে হবে।

 তারপর ডাইরেক্ট কোন সংঘর্ষ আর হয়নি। তবে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। তখন আমরা ফুলবাড়ি ডিফেন্সে ছিলাম। লালমনিরহাট থেকে ফুলবাড়ির দিকে একটা রাস্তা গেছে। লালমনিরহাট এবং ফুলবাড়ি মধ্যে ধরলা নদী। ফেরীর ওপারে অর্থাৎ ফুলবাড়ির দিকে আমাদের এফ-এফ কোম্পানী ডিফেন্স ছিল এবং ডানদিকে এম-এফ কোম্পানীর ডিফেন্স ছিল। এম-এফ কোম্পানী ছিল মোবাইল। তারা ঐ এলাকায় যেতো, পেট্রোলিং করে আবার ফিরে আসতো। কিন্তু এফ-এফ কোম্পানী পার্মানেণ্টলি ওখানে থাকতো। একবার আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। সারারাত ওখানে পেট্রোলিং করেছি। আমার জীবনে এই প্রথম সেদিন গুলি ছুড়ি। আমাকে সেখানে শিক্ষা দেয়া হয় কিভাবে গুলি ছড়তে হয়। সারারাত খাওয়া হয়নি। দুপুরবেলা খাবার কিছু পাইনি। স্থানীয় এক বাড়িতে বসে আমরা জাউ খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের উপর মেশিনগানের ফায়ার। নাদীর এপার ওপার। মাঝখানে নদীর দূরত্ব ৫০০/৬০০ গজ। আমরা যে বাড়িতে খাচ্ছিলাম সে বাড়ির কলাগাছে এবং টিনের চালে খুব গুলি পড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গিয়ে পজিশন নিলাম। প্রশিক্ষণ তখনও কিছু নেই। তবে একটা