পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
330

॥ বড়খাতা ব্রীজঃ ব্রীজ অন রিভার তিস্তা ॥

 রাজধানী ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে বসে যারা ব্রীজ অন রিবার কাউয়াই” দেখে আতংকে ভয়ে শিউরে ওঠেন, তাদের কেউ জানলেন না কোনদিন যে, একাত্তরে সারা বাংলার বুক জুড়ে ব্রীজ কাউয়াই' এর চেয়ে লোমহর্ষক বহু অপারেশন করেছিল আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

 ‘বড়খাতা ব্রীজ’ অপারেশন তার একটি। এই ব্রীজটি উড়ানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্ল্যান করে মে মাসে। এই ব্রীজটি পাক হানাদারদের জন্য ছিল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কেনন, এই ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। যার সাথে রংপুরের সমগ্র এলাকা যুক্ত রেখে পাকবাহিনী ভারী রসদ ও সমরাস্ত্র সরবরাহ অটুট রেখেছে। এই ব্রীজ খতম করতে পারলে সরাসরি রংপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে হাতীবান্দা, বড়খাতাসহ ২২ মাইল এলাকা।

 ৬নং সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার খাদেমুল বাদশার সিদ্ধান্ত নিলেন হানাদারদের রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে। ওদের কাবু করতে হবে এবং এই বড়খাতা ব্রীজ উড়িয়ে দিতে হবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটা কমাণ্ডো গ্রুপ পাঠালেন তিনি। বড়খাতা ব্রীজের ওপর পাক-পাঞ্জাবীর বাহিনী ছিল প্রস্তুত। কোন সুযোগই ছিল না। মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডো গ্রুপটাকে কাছে ভিড়বার। ফিরে এলো তারা।

 জুলাই মাসের মাঝামাঝি আরেক কমাণ্ডো গ্রুপকে পাঠালেন। দুর্ভেদ্য সে অঞ্চল। পিঁপড়ের মত ছেয়ে আছে পাকফৌজ ব্রীজের ওপরে। নীচে। ডাইনে ও বামে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তারা।

 আগস্ট মাসের ৪ তারিখ। তৃতীয়বারের মত একটা গ্রুপ গেল সাথে প্রাক্তন ই-টি-আর বাহিনী বাঙ্গালী জোয়ান। ব্রীজের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছেছিল তারা। কিন্তু না। হানাদার বাহিনী শকুনের চোখ মেলে প্রস্তুত ছিল। ফায়ার ওপেন করে দিল আমাদের কমাণ্ডো গ্রুপটার ওপর। ক্যাজুয়েলটিসহ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তারা।

 বসলেন কমাণ্ডার খাদেমুল বাশার। হেডেকোয়ার্টারে ডাকলেন ঐ এলাকার সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে (বীরবিক্রম), ডাকলেন কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকারকে (বীরপ্রতীক)। চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়ে গেল হাতীবান্দার ম্যাপ নিয়ে। পথঘাট এঁকে দিয়ে দিলেন তিনি ক্যাপ্টেন মতিউর ও হারেসউদ্দিনের কাছে।

 পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ১ কোম্পানী ফোর্স ছিল এই ব্রীজ রক্ষায়। এতেই অনুমান কারা যায় এই ব্রীজের গুরুত্ব তাদের জন্য কত অপরিসীম ছিল। পাকিস্তানীদের পজিশন ছিল বড়খাতা ২ নং ব্রীজের ওপর ও দুই সাইড। রেলওয়ে স্টেশন ও গড্ডিমারির সংযোগ এই ব্রীজটি ছিল তিস্তা নদীর ওপর।

 তিন-তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর এই গুরুত্বপূর্ণ ‘এ্যাসাইনমেণ্ট' ঘাড়ে তুলে নিলেন বাংলার দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর ও হারেস। তৃতীয় ব্যর্থতার ৮ দিন পর ১২ই আগস্ট, রাত ৮ টা। এক কোম্পানী শক্তিশালী পাঞ্জাবী আর্মির সামনে কতজন বাঙ্গালী বীর গেলেন? ১২ জন। হ্যাঁ, মাত্র ১২ জন বাঙ্গালী বুকে দেশপ্রেমের মন্ত্র নিয়ে, মুখে কলেমা শাহাদাত 'লাইলাহা ইল্লাল্লাহু' পড়তে পড়তে বাউরা রেলস্টেশন থেকে যাত্রা করলো ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বীরবিক্রম), কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকার (বীরপ্রতীক), মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন (পরে যিনি পাটগ্রামে হানাদারদের হাতে শহীদ হন), নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, শওকত আলী প্রমুখ। হাতে তাদের এক্সপ্লোসিভস, ডেটনেট, এল-এম-জি, স্টেনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার। তাদের পেছনে প্রয়োজনমত কভারিং দেয়ার জন্য লেঃ মেজবাহউদ্দিনের (বীরবিক্রম) ও সুবেদার আবদুল মালেকের নেতৃত্বে ২টা এফ-এফ কোম্পানী থাকলো। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাউড়া থেকে জীপে যাত্রা শুরু করে তখন পাক-পজিশন ছিল ৫ মাইল দূরে ‘বড়খাতা ব্রীজ'। পাকবাহিনীর পজিশনে দুই মাইল দূরে গিয়ে জীপ যখন থামলো রাত তখন পৌনে বারোটা। জীপ থেকে সবাই নামলো। এবার হাঁটার পালা। পায়ের তলায় শুকনো পাতা ও যেন না পড়ে এমন