পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
333

পথে। ৪ঠা সেপ্টেম্বরের শঠিবাড়ি বন্দরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলনের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, পশ্চিম গগনে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে, ঠিক তেমন সময় গর্জন করতে করতে এলো দুটি হেলিকপ্টার। হারেসউদ্দিন ও তার বাহিনীর বাঙ্কারের পজিশনে বৃষ্টির মত বোমা ফেলল তারা। আক্রোশে ক্ষোভে মুক্তিযোদ্ধারা এল-এম-জি'র ফায়ার করলো। হেলিকপ্টার দুটো চলে গেল প্রায় বিশ মিনিট ধরে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন পজিশনে বোমা বর্ষণ করে। ডান পায়ে, ডান হাতে এবং কপালে বোমার আঘাতে আহত হলেন সেই বীর তরুণ, যিনি ছিলেন সেই তিনশ' মুক্তিযোদ্ধার বীর নায়ক। আহত হলো আরো অনেকে। এক নিমিষেই নিভে গেল সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের আশা। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত আহতদের ব্যাণ্ডেজ ও ফার্স্ট এইড শুরু হলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ৬নং এইচ-কিউ'এর সাথে সকল যোগাযোগ। খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর উপর বোমা পড়ায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল যদিও অস্ত্র ও গোলাবারুদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার এবং ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় হানাদার বাহিনী শুরু করলো নতুন উদ্যমে গুলি-গোলা বর্ষণ।

 সেই অসহায় অবস্থায় ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাত্রে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পড়েছিল তখন রক্তাপ্লুত কোম্পানী কমাণ্ডার চীৎকার করে বললেনঃ “যুদ্ধ চলবে, মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে, কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। কাউকে যদি পিছনে তাকাতে দেখি, এই আহত অবস্থায় তার উপরে আমি গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মত লড়ে প্রাণ দাও সবাই। হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা তিনশ' জন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে নাও আমরা সবাই মরে গেছি।” তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বললেন, “মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই লড়ে যাও।”

 মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেল। আবার ফিরে গেল বাঙ্কারে। হাতে তুলে নিল থ্রি-নট-থ্রি। এমনভাবে পার হয়ে গেল ৪ তারিখ রাত। পাঁচ তারিখ সারাদিন যুদ্ধ চললো -সন্ধ্যায় দু'পক্ষেই ফায়ার বন্ধ হলো। সারারাত আহতদের সেবা শুশ্রূষা হলো। ছয় তারিখ ভোরে হানাদার বাহিনী ছয় ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লাঞ্চার দিয়ে তুমুল আক্রমণ শুরু করলো।

 একদিকে খাবার নেই। আড়াই দিন পার হয়ে যাচ্ছে। বিস্কুট এবং পানি খেয়ে বেঁচে আছে তিনশ' মুক্তিযোদ্ধা। শুধু ব্যাণ্ডেজ বেঁধে আহতরা পড়ে আছে বাঙ্কারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে পাকিস্তানী কামানের গোলা, মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সবদিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তবু মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেল। সবকিছু অনিশ্চিত জেনেও দাঁতে দাঁতে কামড়ে জীবন বাজি ধরে লড়ে গেল শঠিবাড়ি বন্দরে। ছয় তারিখ রাত আটটায় শঠিবাড়ির ডানদিকে মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিকভাববে তিনশ' গজ ছুটে গিয়ে হানাদারদের কয়েকটি ডিফেন্স পজিশন দখল করে নেয়। এটা ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেই ডিফেন্স লাইনে ছিল প্রায় দেড়শ' রাজাকার। তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আহত কোম্পানী কমাণ্ডারের নির্দেশ মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রণ্ট লাইনে বসিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি চালাবার আদেশ দেয়া হয়। ধৃত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। চাঙ্গা হয়ে ওঠে তারা। ৬ই সেপ্টেম্বর সারারাত গুলি আর পাল্টা গুলি চলতে থাকে। ৭ই সেপ্টেম্বর ভোর বেলা পাকবাহিনী অবস্থান ত্যাগ করে নীলফামারীর দিকে পালিয়ে যায়। ৭ই সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ২০ মিনিটে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে উড়লো মুক্তির পতাকা।