পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
11

তাই নয়, পাক-বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে গেঁয়ো পোশাক পরা একদল লোক ফলমূল, মাছ, চাউল এবং লবণের ঝুড়ি নিয়ে ফেরী নৌকায় উঠলো এবং চালক যখন নিশ্চিত মনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে কর্ণফুলীতে পারি জমালো তখনো পাকিস্তানীরা কিছু বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবেছিলো বাজার সেরে বাড়ি ফিরছে। এই সব হাটুরে সওদার জন্য আগেই তাদেরকে টাকা-পয়সা দেওয়া হয়েছিলো। প্রতিটি ঝুড়ির একেবারে তলায় চটের থলেতে ছিলো লিমপেট মাইন, 'ফিন' ইত্যাদি। আবার কোনটায় ছিলো স্টেনগান।

 ১৪ই আগস্ট রেডিওতে দ্বিতীয় বাংলা গানটি শোনা গেলঃ “আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাইনি কোন দান”। আসলে এটা ছিলো সাংকেতিক নির্দেশ। যার ফলে সেই রাতেই নৌ- মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানী জাহাজসমূহে আঘাত করার কথা।

 কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই দলের অভিযান একদিন পিছিয়ে গেলো। ৩ নম্বর গ্রুপ ছাড়া সকলেই রাতের মধ্যে চরলাক্ষায় পৌঁছে গিয়েছিলো। ৩ নম্বর গ্রুপের যোদ্ধারা প্রায় ৮০ মাইল হেঁটে আসার পর ১৪ই আগস্ট একটি দিন তাদের বিশ্রাম দরকার। দিনের আলোতে কিছুটা ' রেকি করাও দরকার। লক্ষ্যবস্তুগুলো প্রতিটি সদস্যের দেখা উচিত। যেখান দিয়ে তারা পানিতে নামবে এবং কাজ শেষ করে যেখানে তাদের উঠতে হবে সেসব জায়গাও আগে থাকতে দেখে রাখতে হবে। তাই একেবারে তাড়াতাড়ি করলেও পরবর্তী রাতের আগে কিছু আর হচ্ছে না।

 ১৪ই আগস্ট এখানে কিছু না ঘটলেও শত্রুপক্ষের জন্য সময়টি খুব একটা স্বস্তির ছিলো না। সারা রাত্রি সমগ্র সীমান্ত এলাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের যোদ্ধারা অসংখ্য আক্রমণ চালায়। আমাদের হতাশাগ্রস্ত জনগণও চাইছিলেন তাদের ছেলেরা ১৪ই আগস্ট কিছু একটা করুক। এমন একটা কিছু করুক যাতে পাকিস্তানীদের উচিত শিক্ষা হতে পারে।

 ১৫ই আগস্ট চরলাক্ষায় আমাদের ৪০ জন তরুণ-যাদের অধিকাংশেরই বয়স বিশের কোটা পার হয়নি- তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে স্বল্পক্ষণের একটু ঘুম দেয়।

 রাত ১টা। বন্দরনগরী পুরো নিদ্রামগ্ন। শান্ত নদীতে শুধু স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি। নিঃশব্দে ওরা নদীর পাড়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়। অপর পাড়ের জেটিগুলো তখন বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল। সার্চলাইট ফেলে নদীর ওপর লক্ষ্য রাখছে সান্ত্রীরা। ওরা ক্লান্ত। হয়তো ঘুমে ঢুলুঢুলু।

 ১৪ই আগস্ট এবং তার পূববর্তী কয়েকদিন পাকিস্তানীদের ওপর দিয়ে বেশ বড় রকমের ধকল গেছে। এ-রাতে তাদের সকলেই যেন একটু নিশ্চিন্ত। পাকা প্লাটফরম-এর ওপর লম্বা লম্বা ক্রেনের ছায়াগুলোকে কেমন ভৌতিক মনে হয়। তবে সান্ত্রীরা এ ছায়া চেনে। নদীর দিক থেকে তাদের কোন ভয়ের আশংকা নেই। কোন নৌকা কিংবা সাম্পান জাহাজের দিকে অগ্রসর হতে চাইলেই পরিস্কার দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে দূরপাল্লার অস্ত্রের কয়েকটি রাউণ্ডই যথেষ্ট। কিন্তু তেমন কখনো ঘটেনি।

 এমভি আল-আববাস এসেছে ৯ই আগস্ট। ১২ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা এই জাহাজ ১০,৪১০ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে।

 একখানি বার্জে (ওরিয়েণ্ট বার্জ নম্বর ৬) ২৭৬ টন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই করে মৎস্য বন্দরের জেটির সামনে রাখা হয়েছে। এটাকে ট্রেনে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হবে।

 এমভি হরমুজ ১৪ই আগস্ট চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে ৯,৯১০ টন সমর সম্ভার। ১৩ নম্বর জেটিতে জাহাজটি ভেড়ানো।