পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
353

 শত্রুপক্ষের একজন চেঁচিয়ে উঠল 'হল্ট' 'হ্যাণ্ডস আপ'। নায়েক মিহনাজউদ্দিন, সম্মুখবর্তী সেকশন-এর কমাণ্ডার, তারাই জবাবে আমগাছের আড়াল থেকে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “তেরা বাপ আয়া, শালা সারেঙ্কার কর'। একথা শেষ হতে না হতেই শত্রুপক্ষ পুলের উপর থেকে একটা এল-এম-জি ও তিন-চারটা রাইফেল থেকে গুলি চালালো আমাদের প্লাটুনের উপর কালবিলম্ব না করে। আমাদের প্লাটুন ঝাঁপিয়ে পড়ল দুশমনদের উপর। পেছন থেকে আমাদের মেশিনগান সহায়তা করে চলল। পুল দখলে এসে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে, দুশমন অনুধাবন করার আগেই দু'জন শত্রুসেনা মারা গেল। দু'জন ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে পালিয়ে গেল। একজন আহত হল এবং বাকী ১১ জনকে বন্দী করা হল। আমাদের পক্ষে একজন নিহত ও একজন আহত হয়।

 পুল কব্জা করার সাথে এক নম্বর প্লাটুনটি পুলের উপর দিয়ে নওয়াবগঞ্জের দিকে দ্রুত ধাবিত হল। নওয়াবগঞ্জ শহর থেকে মাত্র এক হাজার গজ দূরে রাস্তার পাশেই তারা মর্টারের জন্য স্থান বেছে নিল আর শহরের উপর শুরু হল গোলাবর্ষণ। শত্রুপক্ষ কোনদিন এত নিকটে আমাদেরকে আশা করেনি। হানাদার বাহিনীর জন্য মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে নাকি সে সময় বেশ জমে উঠেছিল টাউন হলে আলবদর বাহিনীর বদৌলতে। প্রথম গোলা টাউন হলের নিকটে পড়ার সাথে সাথে প্রধান অতিথিসহ তাদের চেলা-চামুণ্ডা হলঘর ছেড়ে দে ছুট- এই বুঝি শহর মুক্তিবাহিনীর কবলে গেল। যখন এদিক থেকে গোলাবর্ষণ চলছিল তখন সব কয়েকটি দুশমনের অবস্থান থেকে গোলাগুলি আসছিল। তৃতীয় গ্রুপটি তাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই দুশমন তাদের মেশিনগান আর রহিফেল থেকে গুলি ছোড়া শুরু করল। তৃতীয় গ্রুপটি পুল দখল করতে পারেনি। এদিকে দু'নম্বর গ্রুপটি পুল উড়াবার কাজ করেই চলছে। ‘ডিপ মাইন ও প্রেশার চার্জ দিতে হবে। পুলের গোড়ার অংশ ৫ ফুট পরিমাণ খুঁড়তে হল ডিপ মাইন' চার্জ বসাবার জন্য। আমাদের প্রয়োজন ছিল সাড়ে চারশত পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভের। আমাদের কাছে ছিল যে সময় তিনশত পাউণ্ড জিলাটিন এক্সপ্লোসিভ যেগুলো সাধারণত খনিজ পদার্থের মাইন। ফিল্ডে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ছয়টি পুরাতন ধরনের ব্রিটিশ এ্যাণ্টি ট্যাংক মাইন সাথে আনতে বলেছিলেন মেজর সাহেব। সেগুলো জুড়ে দিয়ে পুলের এবেটমেণ্ট উড়াবার জন্য চার্জ তৈরী করতে বললেন মোট ২৪০ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে। উপরে অনুমান একশত দশ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে প্রেশার চার্জ লাগান হল। মাটি ভরে দিয়ে ডিপ মাইন চার্জ আর পুলের উপর প্রেশার চার্জ লাগিয়ে রিং যেন সার্কিট বানান হল কর্ডেক্স-এর সাহায্যে। এদিকে মর্টার প্লাটুনের কয়েকজন ফেরৎ এসে পড়েছে। পুলের উপর উঠে পুলটা শেষবারের মত দেখে নিলেন আমাদের অধিনায়ক মেজর গিয়াস। বন্যার পানি পুলের উপর ছুঁই ছুঁই করছে, আর স্রোতের গতিবেগ জোরে বয়ে যাচ্ছিল। নওয়াবগঞ্জের দিক থেকে কিছু মর্টার আর মেশিনগানের গুলি পুলের দিকে আসছিল। এক সময় আমরা সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিলাম যখন দু'তিনটি গাড়ীর বগী রাজশাহীর দিকে থেকে আসতে দেখতে পেলাম রাজপথ ধরে, কিন্তু কিছু দূর আসতেই যেন গাড়ীর বাতিগুলি থেমে গেল। তারপর বুঝতে পেলাম যে রাস্তা এক মাইল পেছনে জলমগ্ন হয়ে আছে যার ফলে গাড়ী আর বেশীদূর এগুতে পারেনি। ওরা রাস্তার পেট্রোলিং-এ বেরিয়েছিল সম্ভবত।

 রাত ঠিক বারটা বেজে পাঁচ মিনিট। সকলকে প্রায় ছয় শত গজ দূরে নৌকায় বসতে হল কানে হাত চেপে। ফিউজে আগুন লাগাতে বললেন অধিনায়ক। পেছনে দৌড়িয়ে এসে ৫০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে বসে পড়লাম, মেজর গিয়াস ও সুবেদার আমিরুজ্জামান। গগনবিদারী আওয়াজে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সেই আওয়াজের সাথে সাথে বেশ কয়েকটি গ্রামের লোক ঘুম থেকে চীৎকার করে উঠল, ভাবল হয়ত কেয়ামত এল বুঝি। বেশ কয়েক সেকেণ্ড লেগে গেল আকাশে উত্থিত ইট, কংকর, পাথর নেমে আসতে। আনন্দে উচ্ছ্বাসে সকলে দৌড়িয়ে গেল পুলের অবস্থা দেখতে। পুল আর দেখা যাচ্ছে না-দেখা যাচ্ছিল অপর অংশের অর্ধেকটা দূরে কাত হয়ে পড়া অবস্থায়। স্রোতের টানে ইত্যবসরে ছোট নদীটার এপারের অংশ পুলের ভিত্তিপ্রস্তর থেকে আরও ১০/১৫ ফুট বেড়ে গেছে। আমরা নৌকায় উঠে আরও একটু পেছনে চলে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে