পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
357

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খন্ড

 সৌভাগ্য খানদের। পেছনের ট্রাক প্রায় ১৫০ গজ ব্যবধানে এলো এবং এ্যামবুশের এলাকায় এক ইঞ্চি ঢোকা মাত্র ক্যাপ্টেনের শিস সাথে ফায়ার। বজ্র কড় কড় আওয়াজের মত ভেংগে পড়লো মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ওপর। এমন হাতের মুঠোয় বহুদিন পায়নি খানদের। সম্পূর্ণ নিরাপদে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা। পেছনের ট্রাক, সামনের ট্রাক-দুই ট্রাকের ওপরেই চলছে বৃষ্টির মত থ্রি-নট-থ্রি আর এল-এম-জি’র ফায়ার। সম্বিত ফিরে পাবার আগেই পেছনের ট্রাক শেষ, এ্যামবুশের যেখানে ঢুকেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে। খুনী ৩২ জন হানাদারদের ছিন্নভিন্ন দেহ সেখানেই লুটিয়ে। কোনটা ট্রাকের ওপর। বাকীগুলি পাশে, রাস্তায়, নীচের খানায়। কিন্তু না, সামনের ট্রাককে ততখানি কাবু করা গেল না। মাত্র দুটো ডেডবডি পেছনে ফেলে ট্রাকটি গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের কব্জা থেকে- যদিও ট্রাকটি পালাবার আগেই গাছের ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ফায়ার করে কয়েকজনকে আহত ও নিহত করে। পাওয়া যায় বহু গোলাবারুদ, এক ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এল-এম-জি, দুই ইঞ্চি মর্টার এবং চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল কিছু। ৩রা অক্টোবর সেই সাফল্যের পর এ্যামবুশে হানাদারকে খতম করার পরিকল্পনা ক্যাপ্টেন ইদ্রিস বাড়িয়ে দেন এবং বহু এভাবে খানসেনারা ঐ সেক্টরে হতাহত হতে থাকে এবং গেরিলা যুদ্ধের এই কৌশলের ও সাফল্যের প্রোগ্রাম সকল সেক্টরে জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সব স্থানে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হতে থাকে। ৪ঠা অক্টোবর সেই আম-জাম-বাঁশঝাড়ে ঢাকা স্কুলপাড়া দেখতে যায় হামজাপুরের সকল মুক্তিযোদ্ধা। খানদের চরমভাবে পরাজিত ও খতম করে দেয়ার সেই পবিত্র ভূমিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলপাড়ার মাটি কপালে ছুঁইয়ে যাত্রা করে ফ্রণ্টের দিকে। ১৪ই ডিসেম্বর যুদ্ধে লেঃ সাইদুল্লাহ’র একটা হাতের সমস্ত মাংস কাঁধের নীচ থেকে উড়ে যায়। শত্রুর ব্রাশ ফায়ারে। কিন্তু হাড় ভাঙ্গেনি। দিনাজপুরের রণাঙ্গনে যে বীর বহুবার পাঞ্জা লড়েছে হানাদারদের সাথে বিজয়ের দু’দিন আগে তিনি আহত হন। দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ইদ্রিসও আহত হন অন্য যুদ্ধে এবং তার কোমরের নীচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার লেগে হিপের মাংস ধসে যায়।


৭নং সেক্টর আওতাধীন বগুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা[১]

 পশ্চিমবঙ্গ হইতে সামরিক ট্রেনিং লইয়া সাইফুল ইসলাম বগুড়া জেলার পূর্বাঞ্চলে ফিরিয়া আসে। সাইফুলের নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা দল জুলাই মাসে ধুনট থানা আক্রমণ করে। থানাতে বেশ কিছুসংখ্যক পাঞ্জাবী পুলিশ ছিল। এই অতর্কিত হামলায় ৭ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয় এবং গেরিলা দল পূর্ব বগুড়ার কয়েকটি সামরিক কনভয় এবং হানাদার সৈন্য বোঝাই ট্রেনের উপর আক্রমণ চালায়।

 জুলাই মাসে গেরিলা বাহিনীর কমাণ্ডার হারুনুর রশিদের দল ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনে সিচারপাড়ার উত্তর ধারে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী স্পেশাল ট্রেন বিধ্বস্ত করার ফলে চারজন অফিসারসহ সাতাশ জন পাকসৈন্য নিহত হয়।

 ৭ই আগস্ট সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের সময় ৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা প্রধান আহসান হাবিব (ওয়ালেস)এর নেতৃত্বে তাহার দল সাবগ্রামে একটি মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী লরী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। ঘটনাস্থলেই তিনজন পাকসৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। পুনরায় ৯ই আগস্ট তারিখে বেলা ১১ টার সময় পাকসৈন্যরা বিধ্বস্ত লরীটি উদ্ধার করিতে যায়। ঐ দিনই মাইন বিস্ফোরণের ফলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয়।

 বগুড়া শহরের ওয়াপদা পাওয়ার হাউস সাব-সেকশন উড়ইয়া দেওয়ার অভিপ্রায়ে সাইফুল ইসলাম মত্র দুইজন সঙ্গী লইয়া ১১ই আগস্ট হাটসেরপুর হইতে বগুড়া শহরের দিকে রওনা দেয়। তাহারা ৯ ঘটিকায়


  1. এ. জে এম শামসুদ্দিন তরফদার-রচিত ‘দুই শতাব্দির বুকে’ বগুড়া, ১৯৭৬ থেকে সংকলিত।