পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
369

 সাহেব যা বললেন তার অর্থ হল- এই যে সেক্টর কমাণ্ডারদের অনাস্থাবশতঃ কর্নেল ওসমানী পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। তিনি অনুরোধ করলেন যে, ঐ সঙ্কট মুহূর্তে সেনাপতির পরিবর্তন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অগভীরতা ও অনৈক্যেরই পরিচালক হবে। ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমরা সমস্ত সেক্টর কমাণ্ডারই কর্নেল ওসমানীর সেনাপতিত্বে আস্থা প্রকাশ করি।

 প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলতে চাই যে, কর্নেল ওসমানীর আদেশক্রমে আমার সেক্টর-এর ইপিআর বাহিনী থেকে ভাল ভাল যুবক সৈনিকদের একএক করে ছিন্নমূল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে পুনঃসংগঠিত করি এবং আমরাই পাকসেনাদের কাছ থেকে দখলকৃত ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে ওদেরকে সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করি। মে মাসের শেষদিকে এই পুনঃসংগঠিত ব্যাটালিয়নকে উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাপতির কাছে নিবেদন করেছিলাম যে, আমার বাহিনীর ‘ক্রিম অব সোলজারস' নিয়ে গেলে আমার সেক্টর- এর সমর ক্ষমতা বহুলাংশে কমে যাবে। তিনি বলেছিলেন যে, আমাকে নতুন নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য দেওয়া হবে। নতুন নতুন প্রশিক্ষিত সৈন্য আমি ঠিকই পেয়েছিলাম কিন্তু তারা ছিল গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য- যাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ও সামান্য টাকা-পয়সা দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। আমার সেক্টর নিয়মিত বাহিনীর যে 'ত্রিম অব সোলজারস' চলে গেল, তার আর কোনদিন রিপ্লেসমেণ্ট হয়নি। সময়ে সময়ে পাকিস্তান থেকে যেসব নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যরা এসেছিল, তাদেরকেও উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও এই সেক্টরের সাফল্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অন্য কোন সেক্টর-এর তুলনায় যে কম ছিল না, আন্তর্জাতিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা এবং টেলিভিশন ও রেডিও রীলগুলি স্টাডি করলেই বোঝা যাবে।

 সপ্তাহকাল কোম্পানী এলাকাগুলো পরিভ্রমণ ও পরিদর্শনের পর ১৫ই আগস্ট বিকেল ৬টায় আমার সেক্টর সদর দপ্তরে পৌঁছে দেখতে পেলাম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেণ্টের মেজর এম এ মঞ্জুর (বর্তমানে কর্নেল) আমার অফিসে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, তিনি প্রপার মুভমেণ্ট' অর্ডার নিয়ে আমার থেকে সেক্টর-এর কর্মভার গ্রহণ করার জন্য এসেছেন। শুনে অবশ্য আশ্চার্যবোধ করলাম যে, আমাকে না জানিয়ে এটা কেমন করে সম্ভব! টেলিফোন করে জানতে পারলাম যে, মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর মুজিবনগরে এসিষ্ট্যাণ্ট চীফ অব স্টাফ (লজিস্টিকস) এই দপ্তরের সংগঠন ও দায়িত্ব পরিচালনার জন্য আমার ওখানে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই সংবাদে সেক্টর-এর নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। আমিও কমাণ্ড পরিবর্তনকে আমার উপর ইনসালট বলে মনে করি। এতদত্ত্বেও সেনাপতির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ১৮ই আগস্ট বিকেলে সেক্টর- এর কর্মভার হস্তান্তর করে আমি মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে হাজির হই।

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম এ মঞ্জুর [১]

২৯-৩-১৯৭৩

 মানসিক দিক থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্যে। পালাবার পথ খুঁজেছিলাম। অবশেষে সে সুযোগ হয় ২৬শে জুলাই। ইতিপূর্বে আলাপ-আলোচনা, পরিকল্পনা করেই রেখেছিলাম। মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, আমার পরিবার এবং আরদালীসহ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। আরও আগে বেরোবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সুযোগ হয়নি, তাছাড়া আমার শিশুসন্তান তখন মাত্র কয়েকদিন ছিল।

 অনেক পথ পেরিয়ে ৭ই আগস্ট আমি কলকাতা আসি। তারপর ১১ই আগস্ট আমাকে ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯ নং সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তবুও যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে এই সেক্টরের দায়িত্বও আমাকে দেওয়া হয়েছিল।


  1. মেজর হিসাবে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।