পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
370

 আসার পর পরই আমি পেট্রাপোলে আমার এলাকা পরিদর্শনের জন্যে যাই। সেখানে শুনলাম ছয়জন রাজাকারকে গণবাহিনীরা ধরে নিয়ে এসেছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদেরকে মুক্তি দেই এবং গ্রামে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে বলি। পরে শুনেছিলাম দুইজন অনুশোচনায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে, অপর চারজন বাংলাদেশের জন্য মরণপণ লড়াই করেছে। ফিরে এসে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকি এবং কতকগুলি অবস্থা লক্ষ্য করলাম।

 গণবাহিনী নিয়মিত বাহিনী থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক। তারা অন্য কমাণ্ডের আওতায় কাজে-চিন্তায় নিয়মিত বাহিনী থেকে আলাদা। বস্তুতঃ পক্ষে গণবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী পৃথক রাজ্যে বাস করতো।

 গণবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে গেলেও পাকবাহিনী আসছে শুনলে সে গ্রাম বা গৃহ থেকে পালিয়ে যেত। এতে কোন মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ক্রমশঃ হারাতে থাকে। অপরদিকে নিয়মিত বাহিনী ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন 'পকেটে' থাকতো। তারা বিস্তৃত পরিসবে ঘুরতো না। বস্তুতঃ তাদের কাজ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। আরও দেখলাম, গণবাহিনীর প্রধানতঃ কাজ ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে। গণবাহিনী কোন কোন সময় জোর করেও কোন কোন বাড়িতে থেকেছে, এতেও বিরুপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। ‘আঘাত কর এবং পালাও' এই নীতির ফলে পরে পাকবাহিনী এসে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, হত্যা করতো লুণ্ঠন সন্ত্রাসও বাদ যেত না। অপরদিকে যেসব রাজাকারদের ধরে সবদিক বিচার না করে হত্যা করতো সেইসব পরিবারের গোটা লোককে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখলাম। এমনিভাবে তারা বাংলার মানুষের সহযোগিতা হারাতে বসেছিল। এছাড়া গণবাহিনী মাঝে মাঝে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো। অপরদিকে একজন নিয়মিত সৈনিক হিসাবে তাদের কাছে যা পাওয়া উচিত তার প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি বুঝলাম গণবাহিনীকে যদি আমার অধীনে নিয়ে আসতে না পারি তাহলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু কতকগুলি সিদ্ধান্ত নেই। (১) সেক্টরটিকে পুরাপুরি পুনঃগঠিত করি। এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। (২) গণবাহিনীকে সম্পূর্ণ আমার আওতায় নিয়ে আসি। (৩) আমার এলাকাকে বিভিন্নস্থানে বিশেষ বিশেষ এলাকায় ভাগ করি এবং সেখানকার জন্য একজন কমাণ্ডার নিযুক্ত করি। সবাই দেশের অভ্যন্তরে থাকবে, যাবতীয় সরবরাহ আমরা করবো-এ সিদ্ধান্তও নিই। (৪) গণবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে রাজনৈতিক উপদেষ্টা পাঠাই। (৫) রাজাকারদের প্রশ্নেও বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলাম।

 আমি আসার পর গণবাহিনীতে ভর্তি বাড়িয়ে দেই। ট্রেনিং-এর সময় কমিয়ে তিন সপ্তাহ করি। প্রতিমাসে তিন হাজর করে গণবাহিনী তৈরী করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। ভিতরে পাঠাবার সময় প্রত্যেকের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি বাবদ রাহাখরচ ৮০টাকা করে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর আরেকটি দিক ছিল তা হলো দেশের ভিতরে এইভাবে সবাই টাকা ব্যয় করলে অন্যেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হলে আমাদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে।

 গণবাহিনী ভিতরে পাঠাবার পর প্রত্যেক গ্রুপের মাত্র একজন সীমান্ত নিকটবর্তী অথবা তার যে কোন নিকটবর্তী আমাদের স্থায়ী ‘পকেটে’ এসে সবার জন্য টাকা, অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিস নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুনর্গঠনের কাজ হয়ে যায়।

 পরবর্তী পর্যায়ে নিয়মিত বাহিনীও ভিতরে এগিয়ে যায়। মোটামুটিভাবে নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনীকে একটি বিশেষ ‘চেইনে' নিয়ে আসি। এতে করে ভাল ফল হতে লাগলো। এই বাহিনী ভিতরে প্রবেশ করলে আমি এদেরকে ‘ট্রাঙ্ক' দেই-যেমন রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া, সেতু ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ইত্যাদি। এসব শুরু হলে পাকবাহিনী ভীষণ বিপদের মুখে পড়ে যায়। আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। শুধু তাই নয়,