পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
371

 'আওতাভুক্ত এলাকাতে যাতে প্রশাসনযন্ত্র চালু হয় এবং সুষ্ঠুভাবে চলে তার নির্দেশ দেই। এতে করে ভাল ফল পাওয়া গেল। ত্বরিত যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন স্থানে অয়ারলেস সেট পাঠাই এবং এ বিষয়ে একটি দলকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করি। দেশের ভিতরে গিয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছেলে বেছে এনে ‘ইনটেলিজেন্স' বিভাগ খুলি। এর ফলে যাবতীয় খবরাখবর আমরা অতি সহজে পেতে লাগলাম। আমাদের অগ্রগতি এগিয়ে চলে।

 অপরদিকে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে শুধুমাত্র পাকবাহিনীকে হত্যা বা তাড়ানোর ব্যবস্থা করলেই চলবে না, তাতে করে পুরা প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে সেদিকেও নজর দিতে হবে। এ কাজের প্রাথমিক দিক হিসাবে আমি প্রথমে পুলিশ থানাগুলি দখল করতে বলি। অপরদিকে চালনা এবং মঙ্গলা পোর্ট যাতে অকেজো হয়ে যায় তার নির্দেশ দেই। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়-নৌবাহিনীর একটি দল বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

 এইভাবে কাজ করে যেতে আমরা একের পর এক জয়ের পথে এগিয়ে গেলাম। গণবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করতে লাগলো। মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে যেটি প্রয়োজন, জনসাধারণের সমর্থন, তা পেতে লাগলাম। আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে গেলাম।

 এরপর নভেম্বরের ২০ তারিখে থেকে মিত্রবাহিনী আমাদের সাথে আসে। এবং মিত্রবাহিনী ও আমাদের বাহিনী মিলিতভাবে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা জয় করে চললো। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়।

 আলবদর বা আলশামসদের ক্ষেত্রে অন্য কথা হলেও রাজাকার প্রশ্নে বলা যায় যে, তারা সবাই সমান ছিল না। এদের অনেকেই আমাদের পক্ষে কাজ করেছে, যদিও মানুষ এদের ঘৃণা করতো।

 সত্যিকার অর্থে যশোর সেনানিবাসটাকেই গণকবরস্থান বলা যেতে পারে। কারণ বিভিন্ন স্থানে ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে যা পাওয়া গেছে, শোনা গেছে, দেখা গেছে, তা অবর্ণনীয়। যাবার পথে পাকবাহিনী সেনানিবাসের বহু ব্যারাক ও স্টোরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সেনানিবাসের ভিতরে মডেল প্রাইমারী বিদ্যালয়, দাউদ বিদ্যালয় ইত্যাদি স্থান ছিল চাপ চাপ রক্তে ভরা। অনেক মানুষকে রশি দিয়ে গাছে টাঙ্গিয়ে হত্যা করা হতো। আরও শুনলাম কিভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে, তার পরিচয় পাওয়া গেল।

 ডিসেম্বর পুরামাত্রায় যুদ্ধ বেধে গেলে বাংলার মানুষ আনন্দিত হয়ে উঠে। তারা উন্মুখ হয়ে থাকে মিত্র আর মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষায়।

 মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীকে বাংলার মানুষ প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, নারী, সবাই যে যা পেয়েছে তাই দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। স্বাধীনতার পর জনমনে সাড়া পড়ে যায়। বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে।

স্বাক্ষরঃ মঞ্জুর
২৯-৩-৭৩