পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
373

কৃষক জমি চাষ করার জন্য ঐ পথ দিয়ে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র মনে করেছিল যদি কৃষকের লাঙ্গলে এক্সপ্লোসিভের তার লাগে তবে তারটি উপরের দিকে উঠে যাবে। তাই ভেবে, কৃষকটি তারের কাছে আসার পূর্বেই, সে এক্সপ্লোসিভ ফাটিয়ে দেয়, এর ফলে প্রচণ্ড আওয়াজ করে ব্রীজটি ধ্বংস হয়। এ আওয়াজ পেয়ে গ্রামবাসীরা যার যার ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঐ মুক্তিযোদ্ধারা আখক্ষেতে থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাবুল ও নায়েক বাশার গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে যায়। কিন্তু গ্রামের মুসলিম লীগ দালালের খপ্পরে পড়ার ফলে মুসলিম লীগের দালালরা তাদেরকে দর্শনা পাকফৌজ ক্যাম্পে চালান করে দেয়। এরপর তাদের দুজনকে যশোর ও পরে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা বেতার থেকে তাদের বিবরণী প্রচার করা হয়েছিল। তাদের প্রহার করে কিছু কিছু গোপন সংবাদও তাদের মুখ থেকে বের করা হয়েছিল।

 জুন মাসে তেমন কোন অপারেশন হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় মাইন পোঁতা হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গ্রেনেড দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারাও কোন অপারেশন করতে পারে নাই।

 জুলাই ১৯৭১: ১৩ই জুলাই দর্শনা পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ উদ্যোগে রেইড করার ফলে ১২/১৪ জন পাকসেনা মারা যায়।

 দর্শনা-ঝিনাইদহ রাস্তার ডিঙ্গাসহ ও জালসুক ব্রীজ দুটি এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। এর ফলে পাকবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।

 জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনা, জীবননগর, হাঁসদহ, খালিশপুর, কোটচাঁদপুর, কাপাশডাঙ্গা, দত্তনগর, কালিগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে সড়ক ও রেলব্রীজের উপর এত বেশী মাইন পাতে যে, শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে বালির গাড়ী লাগিয়ে চলাচল করত, যাতে মাইনের আঘাতে ইঞ্জিন নষ্ট না হয়। এমনকি তারা গ্রামের লোকদের হাতে লণ্ঠন দিয়ে রাত্রে পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করে, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন লাগাতে না পারে। কিন্তু এত বাধাবিপত্তির ভিতরও মুক্তিযোদ্ধারা মাইন লাগাত। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসগুলিতে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে ট্রেনিং নিয়ে আমার ক্যাম্পে আসত, তাদেরকে ভিতরে বেইস গড়ার জন্য পাঠাতে থাকি। এ বেইসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ক্যাপ্টেন ওহাব সাহেবের নেতৃত্বে যশোর জেলার মাগুরাতে এবং কুষ্টিয়া জেলার হরিণাকুণ্ডুতে আবদুর রহমান নামে একজন প্রাক্তণ সৈনিকের নেতৃত্বে ক্যাম্প খোলা হয়। ক্যাপ্টেন ওহাবের সাথে ছিলেন সহকারী লেঃ মোস্তফা এবং ৭০ জন নিয়মিত বাহিনীর লোক। ক্যাপ্টেন ওহাব মাত্র ৭০ জন সৈনিক নিয়ে মাগুরাতে যান। এ সংবাদ পাকসেনারা জানতে পায়। কিন্তু গুজব রটে যে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ৭/৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা মাগুরাতে অপারেশন করতে আসছে। এ সংবাদ জেনে পাকবাহিনীর সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনী ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের সময় মাগুরা থেকে ফরিদপুর চলে যায়। ক্যাপ্টেন ওহাব একটি গোপন সংবাদ যৌথ সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছায় যে, মাগুরাতে পাকসেনাদের পেট্রোল ডিপো আছে। ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে পেট্রোল ডিপোর্টি ধ্বংস হয়ে যায়। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে হরিণাকুণ্ডু ক্যাম্পের আবদুর রহমানের দল হরিণাকুণ্ডু থানা আক্রমণ করে। এর ফলে একজন পাকিস্তানী ডিএসপি মারা যায় এবং ডিএসপি'র পোশাক হেড অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং ঐ থানা আক্রমণে কয়েকজন পুলিশ মারা যায়।

 নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভারতীয় সৈন্যরা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে। দর্শনা সীমান্তের বাঁ দিকে মদনাতে ভারতীয় বাহিনীর ৪১ পার্বত্য ব্রিগেডের কিছু অংশ ঐ সমস্ত স্থানে মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে করে ডিফেন্স নিতে আরম্ভ করে। ভারতীয় বাহিনীর উপর একটি ব্রিগেড দর্শনার ডানদিকে (ভারত থেকে ডান দিকে) জীবননগর, দত্তনগর কৃষিখামার, ধোপাখালি এলাকায় রেকি করতে থাকে। ১২ই নভেম্বর রাত্রিতে একটি ভারতীয় প্লাটুন মুক্তিবাহিনীর সাথে মেজর ভার্মার নেতৃত্বে এবং ২ জন ভারতীয় ক্যাপ্টেনের সাথে আমি ধোপাখালী বিওপি রেইড করতে যাই। এই রেইড করার ফলে পাকসেনাদের ১৫/২০ জন