পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
384

করলাম। ওই দিনই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরে পাকিস্তানী পশুগুলোর উপর বর্বরতার সমুচিত জবাব দেবার জন্য মনটা আমার কঠিন হয়ে উঠলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। যাতে করে সাড়ে সাত কোটি অগ্নিদগ্ধ আত্মার শান্তির জন্য হিংস্র জানোয়ারদের উপর চরম 'আঘাত হানা যায়।

 আমরা হিংগুলগঞ্জে নামলাম এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন পাণ্ডের অফিসে হেঁটে গেলাম। তিনি তাঁর অফিসে আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে সুঠামদেহী, সুন্দর ও বেশ লম্বা। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। আমি যা আশা করেছিলাম তার চাইতে বেশী।

 এক কাপ গরম কফির পর আমাকে আবার এখনই ছুটতে হবে প্রথমে হাসনাবাদ, পরে ব্যারাকপুর। প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৭৪ সালের দেশ ভাগের সময় ক্যাপ্টেন পাণ্ডে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে আসেন। আমাকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুব আনন্দবোধ করলেন। তার চোখের কোণে আশা ও প্রত্যয়ের ছাপ দেখলাম।

 আমাদের অনেক রাস্তা যেতে হবে। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ওদের সেনাবাহিনীর পাহারায় আমরা তিনচাকার একটা গাড়ীতে চেপে পড়লাম। এই গাড়ীটির বন্দোবস্ত করেছিলেন মিঃ পাণ্ডে। তিনি হাসনাবাদে আমাদের আগমন বার্তা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

 হিংগুলগঞ্জ থেকে হাসনাবাদের দূরত্ব ১২ মাইল। কিন্তু মাঝপথে আমাদের দুটো খেয়া পার হতে হবে। এই তিনচাকা গাড়ীটা দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগে। এটার নাম টেম্পো।

 বেশ কষ্টকর ভ্রমণের পর আমরা হাসনাবাদ পৌঁছে গেলাম। গণপরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছ থেকে ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং আমার সম্বদ্ধে অনেক কথা আগইে শুনেছেন। মিঃ মঞ্জুর সাথে আগে থেকেই এদের জানাশুনা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন সিং কোমল হৃদয়ের অধিকারী, সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের সবার কাছেই খুব প্রাণখোলা মনে হলো। সামনে এসে মিসেস সিংও আমাদের খোশ আমদেদ জানালেন। এই ভদ্রমহিলা আর এক মধুর ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘাংগী, সুন্দরী। তারা আমাদের সাথে অতি পরিচিত বন্ধুর মত ব্যবহার করলেন। বেশ কয়েক রকম সুস্বাদু খাবার খাওয়ার পর আমরা ব্যারাকপুর যাত্রা করলাম। এখান থেকে ব্যারাকপুর প্রায় সত্তর মাইল সামনে। এবার স্বয়ং ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং-এর পাহারায় রওনা হলাম। হঠাৎ করে ঝড় ও অবিরাম বর্ষণ শুরু হলো। কিন্তু সামরিক গাড়ীগুলোর আশ্রয় পেয়ে কতটা নিরাপদ হলাম। দীর্ঘ দু'ঘণ্টা ভ্রমণের পর গাড়ীটা একটা দালানের কাছে থামলো। ওর গায়ে লেখা ছিল ‘অফিসার মেস’, ৭২নং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে)। এটাই আমাদের সামরিক গন্তব্য স্থান। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে তারাগুলো উঁকি মারলো। বাইরে কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ওদের অফিসার মেসে। আমাদের ৭২ নং বিএসএফ অফিসার মেসে। পথের ক্লান্তিতে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করলাম। সুতরাং শিগগিরই পানীয় এলো। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের ধ্বনি ছড়িয়ে এক ঝলক হাসি মুখে নিয়ে উপস্থিত হলেন একজন নতুন যুবক। ইনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন সরকার। ভাই ও বন্ধুর চেয়েও বেশী অমায়িক ব্যবহার পেয়েছিলাম এই ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে। পরে আমরা আত্মীয়র চাইতে বেশী আপন হয়েছিলাম। এই ৭২ বিএসএফ বাহিনীর এডজুট্যাণ্ট ছিলেন তিনি। মিত্রবাহিনীর বন্ধুদের উল্লাসের ধ্বনিতে আমি স্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। বাস্তবিক পক্ষে আমরা খুব সুখে ছিলাম। এই সময় অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী এসে পৌঁছালেন। অধিনায়কের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। বয়সী লোক। ধূসর চুল, মুখাবয়বে অভিজ্ঞতার ছাপ। আমরা খুব আস্তে আস্তে কথা বললাম।