পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
16

সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনাহারে কাটাতে হয়েছে। শত মাইল দুর্গম এবং পার্বত্য অঞ্চল ও নিবিড় বনানী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য তারা এসেছিলো। কিন্তু কেউ তাদের সম্পর্কে সামান্যতম আগ্রহও প্রকাশ করেনি। তারা যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়িঘর ছেড়েছিল তার স্বীকৃতিও কারো কাছ থেকে তারা পায়নি।

 যুদ্ধে নিয়োজিত গেরিলাদের শতকরা পঞ্চাশ জনের জন্য ভারত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছিলো (পরে অবশ্য শতকরা ৯০ জনকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাবস্থা করা হয়)। বাকী ছেলেদের খালি হাতে যুদ্ধে পাঠানো কিংবা অপেক্ষা করতে বলা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর ছিলো না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ ছিলো, অস্ত্র ছাড়া কাউকে যেন গেরিলা যুদ্ধে পাঠানো না হয়। আমাদের সবচাইতে সহজ উপায় ছিলো দুই গ্রুপের অস্ত্র দিয়ে তিনটি গ্রুপকে পাঠানো। ফলে প্রতিটি গ্রুপের শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ছেলেকে সরবরাহের অপ্রতুলতার জন্য ক্যাম্পে বসিয়ে রাখতে হতো। এদের জন্য আবার রেশন পেতাম না, ফলে সমস্যা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতো। আমরা স্থানীয়ভাবে এর কিছুটা সমাধান বের করেছিলাম। সকল অফিসার, জেসিও এবং অন্যান্য র‍্যাংকের সৈনিক মিলে একটা মাসিক চাঁদার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর মাধ্যমে যা কিছু আয় হতো তা দিয়ে বাড়তি আহার যোগানোর চেষ্টা চলতো। এই ব্যবস্থা ছিলো অনিয়মিত এবং পরিস্থিতির চাপে পড়েই আমাদের এটা করতে হয়েছিলো। অথচ এর জন্যও আমাদের ভুল বোঝা হতো, আমরা হতাম সমালোচনার পাত্র। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদেও সম্পর্কে অনেক গোপন চিঠিতে লিখতেন, “বাংলাদেশের সেক্টও কমাণ্ডাররা পুরো নিয়ম মেনে চলছেন না”। এ বিষয়ে ভারতীয় অফিসারদেও এই মতামত সম্ভবত অনেকাংশে সঠিক ছিলো। তাদেও ওপর ভারতীয় আর্মি হেডকোয়ার্টারের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকতো, গেরিলাদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে সকলকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে হবে-তা সে সবাইকে অস্ত্র সরবরাহ করে কিংবা মাত্র কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেই হোক। কিন্তু আমাদের উপর বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ ছিলো সবাইকে অস্ত্র সজ্জিত না করে কোন গ্রুপকেই যেন বাংলাদেশের অভ্যান্তরে যুদ্ধে পাঠানো না হয়।

 বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টার এবং ভারতীয় আর্মি হেডকোয়ার্টারের মধ্যে সমন্বয় তখনও পুরো গড়ে ওঠেনি বলেই হয়তো আমাদের জন্যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো।

গেরিলা যোদ্ধা

 আগস্ট মাস থেকেই আমাকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র তৈল শোধানাগারটি অচল করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র দুটি ধ্বংস হলে পাকিস্তানীদের চাইতে আমাদের ক্ষতি বেশী হবে বলে মনে করে আমি দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করি। বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন এবং জ্বালানীর অভাব দেখা দিলে শত্রুদের যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়বে এবং এতে করে তাদের তৎপরতাও হ্রাস পাবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো কেন্দ্র দুটি ধ্বংস না করেও অন্যভাবে আমাদের লক্ষ্য হাসিল করা সম্ভব।

 আমরা ভাবনাকে সামনে রেখে একটি নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সঙ্গে কথা বলি। তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে ১,২ এবং ৩ নম্বর সেক্টরের কার্যক্রম ও চাহিদা সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন। আমার পরিকল্পনা ছিলোঃ

 ১। মদনঘাটে বিদ্যুৎ বিভাগের সাব-স্টেশন ধ্বংস করা।

 ২। কাপ্তাই এবং চট্টগ্রামের মধ্যে যতগুলি সম্ভব বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করতে হবে।

 আমার বিশ্বাস ছিলো, দু'টি কাজ করতে পারলেই শত্রুপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে এবং এতে ওদের বাণিজ্য ও অন্যান্য জাহাজ নোঙ্গরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে।