পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
387

বুঝিয়ে বললাম কিভাবে দুটো লঞ্চে অস্ত্রশস্ত্র ভাগাভাগি করে নিতে হবে এবং শত্রুর সাক্ষাৎ পেলে নাগরিকরা কি করবে।

 যাত্র শুরু করার হুকুম দিলাম। একটা লঞ্চে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের এবং আরও কয়েকজন লোক আগে আগে চললো। আমার লঞ্চটা আগেরটার পিছু পিছু রওয়ানা হলো। কারণ, আমার লঞ্চে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অনেক অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ছিল। সামনের লঞ্চটায় মিঃ মঞ্জু ও লেং নাসেরকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার ভারদিলাম। পথের নিরাপত্তা সম্বন্ধে তাঁরা দু'জনেই বেশ আশ্বস্ত ছিলেন। কারণ মাত্র দু'দিন আগেই তাঁরা এই পথে হাসনাবাদ এসেছেন। ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পেট্রোল বোট 'চিত্রাঙ্গদা' আমাদেরকে শামশেরনগর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। এখান থেকেই আমরা যাত্রা শুরু করবো। শামশেরনগর ভারতের শেষ সীমান্ত ঘাঁটি। রাত ৯টা। শুরু হলো যাত্রা। আশা-নিরাশার দোদুল দোলায় সারা দেহ-মনে চাপা উত্তেজনা। যাত্রার লগ্নে দূরে বহু দূরে দেখতে পেলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছাড়াও রাত্রের গুমোট অন্ধকার। গভ কয়েক দিনের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে এলো। ঘুম পেল আমার। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দের মাঝেও আমি গভীর ঘুমে গা এলিয়েদিলাম। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে দেখি কে যেন চাপা গলায় ডাকছেঃ “গানবোট, গানবোট স্যার'।

 হ্যাঁ, সত্যিই তো গানবেট। ভূত দেখার মত উপরতলার ক্যাবিন থেকে ঝড়ের বেগে চীনা 'কার্বাইন’টা' হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ইঞ্জিন কক্ষে ঢোকা মাত্রই দু'দিক থেকে প্রচণ্ড সার্চলাইটের আলো আর মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলো। ভেতরটা আমার অসম্ভব রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানী গানবোট ওঁৎ পেতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। রাতটা ভয়ানক বিক্ষুব্ধ। ঝড়ের দাপাদাপি। তার উপর চারদিক সূচীভেদ্য অন্ধকার আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ। সার্চলাইট দিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে হানাদাররা তন্নতন্ন করে আমাদেরকে খোঁজ করতে লাগলো। একটা গুলি এসে লঞ্চের পিছন দিকটায় আঘাত করলো। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমার সাথের চার জন্য সৈনিক সিদ্দিক, হাবিলদার জববার মোখছেদ ও ইউসুফকে প্রথমে রাইফেলের গুলি করতে বললাম। যেন শত্রুপক্ষ মনে করে আমাদের শক্তি খুব কম। আশ্চর্যজনকভাবে আমার এই পরিকল্পনাটা কাজে এলো। দেখতে পেলাম আমাদের বাঁ দিকের গানবোটটা পুরো সার্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টি ও বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের লঞ্চটার পিছন দিকটায় আরও কয়েকটি গুলি এসে লাগলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে গুলির আওয়াজ় অস্পষ্টভাবে আসছিল। সার্চলাইটের আলোকিত পথটুকুই শুধু চোখে পড়লো। পৃথিবীর আর সব কিছুই দৃষ্টির বাইরে। কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্ত ব্যাপারটা এলোমেলো হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের ভেতর পাল্টা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে যে গানবোট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। সেটা প্রায় লঞ্চের কাছাকাছি এসে গেল। বলতে ভুলে গিয়েছি যে, আমাদের লঞ্চটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এটা নদীর তীরে, না মাঝখানে অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

 দু'জনকে মেশিনগান, দু'জনকে 'এনারগা গ্রেনেড' সজ্জিত রাইফেল দিয়ে বাম দিকে বসিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মেশিনগান ডানদিকের গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই চারজনে ওই গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রচণ্ডভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। এই সময় গানবোটটা আমাদের বেশ আওতার মধ্যে এসে গিয়েছিল। এই অতর্কিত আক্রমণে শত্রুরা ভয়ানক ঘাবড়ে গেল এবং ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। ওদের হৈ চৈ শুরু হলে এর গানবোট থেকে বিরাট একটা আগুনের গোলা ছিটকে পড়লে বুঝতে পারলাম, আমাদের নিক্ষিপ্ত রকেট ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। বামদিকের গানবোটটাকে চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়ে ডানদিকের গানবোটটাকে আক্রমণের উদ্দেশ্য ঘুরে বসলাম। কিন্তু ওটা বিপদের আশংকা করে মেশিনগানের আওতার বাইরে পালিয়ে গেল। যাহোক, শত্রুপক্ষকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার জন্য গুলিবর্ষণ অব্যাহত রইলো। এই সুযোগ অন্য দু'জন লোককে আমাদের আগের লঞ্চটার খোঁজ নিতে বললাম। কিন্তু মনটা