পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
388

ভীষনভাবে দমে গেল যখন দেখলাম আগের লঞ্চটা ঠিক আমাদের বামদিকে চড়ার উপর বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং ওর ভেতরের লোকজন আগেই পালিয়ে গিয়েছে।

 সাথের বেশীর ভাগ লোকজন পালিয়ে গিয়েছে দেখে মনটা ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লো। এমন সময় পালিয়ে গেল যখন তাদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। অযথা চিন্তায় সময় নষ্ট না করে আমাদের সাথের চারজনের প্রত্যেককে এক-একটা ডাল, আমরা তীরের কাছাকাছি ছিলাম। অনিশ্চয়তা, নিরাশা ও ভয়ের আশংকা। আমরা তাড়াতাড়ি লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পায়ের নিচে আঠালো কাদা। কোমর পরিমাণ জলের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে নদীর তীরে পৌছালাম। তীরটা আমার কাছে উঁচু বাঁধের মত লাগলো। নদী থেকে অনেক উঁচুতে বাঁধের উপর তাড়াতাড়ী ঘাঁটি গেড়ে বসলাম। সামনে থেকে যত আক্রমণই করা হোক না কেন আমরা এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অচেনা, অজানা পথ। জীবনে কোনদিন এখানে আসিনি। এসব চিন্তা করে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। শত্রুর উপস্থিতি, ঝড়ের বিলাপ, কুচকুচে কালো আঁধার-সব মিলে রাতটাকে একটা প্রেতাত্মার ছায়ার মত মনে হলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম বাঁধের পিছন দিকে মানুষের একটা অস্পষ্ট ছায়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শংকিত পদে ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটা লোক পালাবার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করছে। এত ভীত যে মনে হলো পৃথিবীটা খুঁড়ে তার ভেতরে গিয়ে লুকাবে। মৃদুভাবে তাকে স্পর্শ করতেই এমন জোরে চিৎকার করতেই জোরে চিৎকার শুরু করলো যে, ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। তাকে সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও সে এমন বিলাপ করে চিৎকার আরম্ভ করলো যে, উপর দিকে একবার চাইবারও সাহস পেল না। গরীব বেচারা। প্রায় বিকারগ্রস্ত। অনেক চেষ্টার পর সে শান্ত হলো। এই লোকটা হচ্ছে সেইসব পাইলটদের একজন যারা লম্বা লম্বা গালভরা কথা বলেছিল। অবশ্য তার কোন দোষ নেই। কারণ সে কোনদিন গুলির শব্দ শোনেনি। যাহোক এই লোকটা আমার অনেক উপকার এ্যলো। আমি কোন জায়গায় আছি এটা সে নির্ভুলভাবে বলে দিল। এসব ব্যাপার এই ক্ষুদে ‘সাহসী' লোকটির স্মৃতিশক্তির বেশ জোর আছে। এই জায়গাটার নাম 'গাবুরা'। জায়গাটার পরিবেশ ও অবস্থানের কথা চিন্তা করে সংশয় জাগলো যে, ভোর হওয়া পর্যন্ত যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে শত্রুপক্ষ হয়তো বা আমাদের মত লোভনীয় বস্তুগুলোর উপর হাওয়াই হামলা চালিয়ে ওদের করেই বসে তাহলে কিছুতেই রুখতে পারবো না। এই অত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কোন রকমে 'ক্রলিং' করে গ্রামের অভ্যন্তরে চলে যাওয়া।

 আমাদের পিছন দিকে এই গ্রামগুলো প্রায় এক মাইল দূরে। ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের গানবোটটা অনেক দূরে পিছিয়ে গিয়ে বাঁধের উপর আমাদের অবস্থান ও নদীর তীরে পরিত্যক্ত লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে ভীষণভাবে মেশিনগান ও রকেটের গোলাবর্ষণ শুরু করলো। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের দুটো লঞ্চেই আগুন ধরে গেল। বর্তমান অবস্থানে থাকাটা অযৌক্তিক ভেবে আমরা ক্রলিং করে কোন রকমে বাঁধের নিচের দিকে চলে গেলাম আর খোদাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কারণ এ দুঃসময়ে এক খোদা ছাড়া আর কেউ শত্রুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। ঠিক এই সময় আমার সঙ্গের চারজন সৈনিক এদিক-ওদিক সরে পড়লো। সম্ভবত তারা গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পাইলট ছাড়া আর কাউকে আমার চারপাশে দেখলাম না। মেশিনগানের গর্জন আর রকেটের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে পাইলট আধমরার মতো আমার কাছে পড়ে রইল। গোলার ভয়ংকর আগুন আমাদের লঞ্চ দুটোকে নির্দয়ভাবে গ্রাস করলো। পরাজিত মন ও ক্লান্ত দেহটা বাঁধের পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে হতাশার গ্লানি নিয়ে চেয়ে রইলাম লেলিহান বহ্নিশিখার দিকে। গোলার প্রচণ্ড শব্দ, রকেট বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। উৎকট গন্ধে ভরপুর সমস্ত আকাশটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন- পরাজয়ের কালিমায় কিছুটা মলিন। পূর্ব দিকটা সামান্য হালকা হতেই পাইলটকে টেনে নিয়ে কোন রকমে গ্রামের ভেতরে ঢুকে সাহস করে সেখানে এক হাজী সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমাদের প্রতি সহৃদয় হবার জন্য ইঙ্গিতে তাকে অনুরোধ জানালাম। যখন তাকে খোদার চাইতেও জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর বেশী অনুগত দেখলাম তখন যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ে মনটা বিচলিত হলো। গ্রামের অধিকাংশ লোককেই