পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
389

দেখলাম বর্বর ইয়াহিয়ার প্রতি অনুগত ও ভক্ত। আমাদের প্রতি ভয়ানক বিরূপ মনোভাবাপন্ন মনে হলো। প্রকৃতপক্ষে এখানকার স্থানীয় লোকজনই আমাদের সাথের লে? নাসের, গণপরিষদ সদস্য মিঃ মহিউদ্দিন ও আরো ছাবিবশজন লোককে ধরে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আমিও এই রকম একটা গন্ধ পেলাম যে হাজী সাহেব আমাদেরকে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দেবার জন্য গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের চারদিকে অনেক লোকের ভীর। তারা আমাদেরকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। আমরা দু'টি যেন অদ্ভুত জীব। আমাদের এরকম দুরবস্থা দেখে ওদের মধ্যে কেউ কেউ দুঃখও প্রকাশ করলো। এ অবস্থা দেখে হাজী সাহেবেরও বোধ হয় দয়া হলো। তিনি আমাদের কিছু ভাত ও মধু দিলেন। এটা সুন্দর বনাঞ্চলের লোকদের একটা বিশেষ খাদ্য। খাবার দেখা মাত্র আমার চোখ দুটো বড় হতে লাগলো। কেননা আমি ও আমার সঙ্গের পাইলট উভয়েই ভয়ানক ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলাম। গত রাতের ভয়ংকর পরিবেশ আমি ওর সাথে বড্ড একাত্ম ও আপন হয়ে গিয়েছিলাম। যখনই এই অনির্ধারিত খাবার শেষ করে ফেলেছি, ঠিক সেই সময় হাজী সাহেব হাতে করে রাইফেলের ‘ছেরেফ’ একটা 'বোল্ট' নিয়ে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, এটা কি? কেননা তার ধারণা ছিলো এটা কোন কাজে আসে না। তার চোখের কোণে ভীতির চিহ্ন।

 এই দালাল শিরোমণিকে নিয়ে কিছু মজা করবো স্থির করলাম। তার হাতে বোল্টটা দেখেই ভীতিজড়িত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং হাজী সাহেবকে বললাম যে, তাঁর হাতের জিনিসটা খুব মারাত্মক ডিনামইট। মাটিতে যেন কোনরকমে না পড়ে তাহলে সবাই মারা যাবে। শুনে হাজী সাহেব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। এইবার হাজী সাহেবকে হাতের মুঠোয় পেলাম। আমার কথায় তার কাঁপন শুরু হলো। তার চক্ষু স্থির, রক্তহীনের মত বিবর্ণ। আপাদমস্তক ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আমার হুঁশিয়ারী স্মরণ করে তিনি বোল্টটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত সৎ সাহসও দেখাতে পারছিলেন না। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে আমি বললাম যে, ডিনামাইডটের হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ওটাকে পানির মধ্যে ফেলে দেয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার কথা খুব আস্তে আস্তে আঙ্গুল টিপে টিপে বোল্টটার দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে হাজী সাহেব পুকুরের দিকে রওনা হলেন। এই দুরবস্থার মধ্যেও আমার ভয়ানক হাসি পেল। যখনই এই মজার ব্যাপারটা ঘটছিল তখন হঠাৎ গানবোট থেকে হাজী সাহেবের বাড়ির দিকে আবার গোলাবর্ষন শুরু হলো। হাজী সাহেবের বাড়ীটা বড় একটা দালান। বহু দূর থেকে দেখা যায়। এই আকস্মিক ঘটনায় গ্রামের লোকজন যে যেদিকে পারল ছিটকে পড়লো। এটা আমাদের পালানোর জন্য আশীর্বাদস্বরুপ দেখা দিল। আমার সাথের পাইলটটি মাত্র নদীর পথ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। সে সাহচর্য ছাড়া আর কোন প্রয়োজন আসলো না। যাহোক, একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দিনটা কোন রকমে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আরম্ভ হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের প্রতি খুব সদয় ছিল। হাজী সাহেবের ব্যবহারে আশ্বাস ও স্বস্তির রেশটুকু খুঁজে না পেলেও আমাদের প্রতি তার ছেলের মমত্ববোধ দেখে এই দুঃসময়েও বাঁচার ক্ষীণ আশায় বুক বাঁধলাম। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের খুঁজে বের করলো। তাকে দেখে ভরসা পেলাম। সে আমাদের আশ্বাস দিল যে, খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছে দেবে। তার সহানুভুতিশীল মনের পরিচয় পেয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম- আবার সেখানে ফিরেগিয়ে সযত্নে প্রহরায় নির্বিগ্নে রাত কাটিয়ে দিলাম। প্রতিশ্রুতিমত হাজী সাহেবের ছেলে রাস্তার সব খবরাখবর আমাদেরকে খুলে বললো এবং খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দিয়ে গেল। খেয়া পার হবার জন্য সে আমাদের কিছু টাকা-পয়সাও দিল। কেননা রাস্তায় অনেক নদী ও খাল পার হতে হবে। পথটা অত্যন্ত বিপদসংকুল। তাছারা সমস্ত অঞ্চলটা পাক দালালে ভর্তি। প্রাণটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে আমরা প্রায় আধ মাইল পথ অতিক্রম করলাম। কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় এইভাবে ভারতে সীমান্তবর্তী ঘাঁটি হিংগলগঞ্জ এসে পৌছালাম। হিংগলগঞ্জের ঠিক উল্টোদিকে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটি বসন্তপুর। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের ফেরার খবর আগে থেকেই পেয়ে ওঁৎ পেতে আমাদের ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু ওদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেলাম। ২৬ জন ছাড়া সঙ্গের অন্যান্য সবাইও পৌঁছে গেল।