পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
393

অনেক ট্রেণ্ড মোজাহিদ আছে। মিঃ শাজাহান বুদ্ধিমান, হাসিখুশী এবং উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা ছিলেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হালকা অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটি মোজাহিদ বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। তারা টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা হওয়ায় ওখানকার পাকিস্তানী ঘাঁটির সঠিক অবস্থান, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য খুটিনাটি সম্বন্ধে বেশ ওয়াকেবহাল ছিল। সুতরাং দুর্যোগময় রাতটার তাৎপর্য আমার কাছে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো।

 ক্যাপ্টেন হুদাকে বিদায় জানিয়ে আমি ও ডাক্তার শাহজাহান দু’মাইল রাস্তা হেঁটে ‘টাকি’ এলাম এবং মিঃ শাজাহানের সাথে আলাপ-আলেচানা করলাম। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে আমার অধীনে কাজ করতে রাজী হলেন। মিঃ শাজাহানের অধীনে লেঃ মুখার্জী নামে একজন অসম সাহসী যুবক কাজ করতো। সে পূর্বে যশোরের অধিবাসী ছিল এবং দাবী করতো যে, সে ভারতীয় সামরীক বাহিনীর একজন ভূতপূর্ব অফিসার। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তিশালী। অন্য দু'দজন মোজাহি সেকশন লিডার মিঃ মণ্ডল ও সোবহানের সাথে লেঃ মুখার্জী একত্রে ট্রেনিং নিয়েছ। টাউন শ্রীপুরে পাক-হানাদারদের ঘাঁটি আক্রমণ করবো শুনে মুখার্জী উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বসন্তপুর অভিযানের মতো এখানেও এদের ইছামতী পার হয়ে যেতে হবে। ইছামতী আরও উত্তরে গোজাডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলোর ঠিক অপর দিকে পাকিস্তানী পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি। আমার সেক্টরে ইছামতী নদীর তীর বরাবর দু'তিন মাইল অন্তর পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর অবস্থান। সর্ব উত্তরে ‘শংকরা'। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে টাউন শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উখসা ও সর্বশেষ কৈখালি। এসমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর শক্তি বিভিন্ন রকমের। ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হলো, রাতের অন্ধকারে এবং গোপনে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে এই বিক্ষিপ্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আবিস্কার করা। এতে করে গেরিলাদের জন্য কতকগুলো গোপন অবস্থানের পরিকল্পনা করা আমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে। যার ফলে একটা মুক্তাঞ্চলে গড়ে তোলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে প্রথম অবস্থায় আমার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সীমান্তে টাকি, হিংগলগঞ্জ ও শমসেরনগর এই তিন জায়গায় আক্রমণ ঘাঁটি করে এর ঠিক বিপরিত দিকে পাকিস্তানী ঘাঁটি টাউন শ্রীপুর, বসন্ত পুর ও কৈখালি অধিকার করা। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা হেতু আমার আশা সফল হয়নি। তবুও আমার কল্পনার উদ্দাম গতি থামেনি। যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এ কথার সত্যতা প্রমাণীত হলো ১৩ই জুন-যখন ক্যাপ্টেন হুদা বাহকের মারফত খবর পাঠালো যে, সেই দুর্যোগময় রাত্রে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ করে ২০ জন হানাদারকে খতম এবং ৫০টি রাইফেল, দু'টি এল-এম-জি, অনেক অসশস্ত্র, গোলাবরুদ, গ্রেনেড ও বিস্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমন্ত শত্রুদের ঘুমন্ত শত্রুদের উপর হামলা চালিয়েছিল। শত্রুপক্ষের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে আমাদের একজন যুবক সামান্য আহত হয় মাত্র। শত দুঃখের মাঝেও বিজয়গর্বে বুক ফুলে উঠলো। লেঃ মুখার্জি, মিঃ মণ্ডল, সোবহান ও মিঃ শাজাহান আমার সদর দপ্তরে এসে খবর দিল যে, তাদের আক্রমণও সফল হয়েছে। ওদের সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিজয়োল্লাসে মিঃ শাজাহান আমাকে অভিনন্দন জানালো। আমিও আন্তরিকভাবে ওদেরকে স্বাগত জানালাম। আমার সুন্দরবনের ব্যর্থতার গ্লানি আজ যেন কিছুটা লাঘব হলো। পরক্ষণেই প্রতিহিংসার দাবানল আমার ভেতর আবার দ্বিগুণভাবে জ্বলে উঠলো। মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ৩৫টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র অধিকার করেছিল। এই বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র হাতে আসায় আমার আক্রমণ পরিচালনা ঘাঁটির পরিধি আরও প্রসারিত করতে মনস্থ করলাম। ওই দিনই মিঃ শাজাহানের সহায়তায় টাকিতে আমার অন্তর্বর্তীকালীন ঘাঁটি স্থাপিত হলো। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী দক্ষ সৈন্যর উপর দুর্যোগের মধ্যে হামলা চালিয়ে এই বিরাট সফলতা অর্জন করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন হুদা, মিঃ শাজাহান, লেঃ মুখার্জী ও মিঃ মণ্ডলকে অভিনন্দন জানালাম। একই সঙ্গে খুব অল্প সময়ের ভেতর সীমান্তবর্তী সমস্ত পাকিস্তনী ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করার ইচ্ছা ওদের কাছে প্রকাশ করলাম। এ ছাড়াও আর একটা জিনিসের উপর জোর দিলাম যে, সীমান্তের ওপারের ছেলেদের জোগাড় করে এই মুহূর্তেই ওদের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জন্য টাকি থেকে দুই মাইল দুরে ‘টকিপুরে' একটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা নিলাম। সীমান্তের ওপার থেকে ছেলে জোগাড় করার দায়িত্ব মিঃ শাজাহানকে দিলাম। বসন্তপুর ও টাউন শ্রীপুরে আমাদের সফলতার খবর