পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
394

সর্বাধিনায়কের কানে শিগগিরই পৌঁছে গেল। ভবিষ্যতে আরও এরকম সফলতা আশা করে তিনি স্বাগত জানালেন।

 ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনীর অনেক লোক ও স্কুল-কলেজের ছাত্র সীমান্ত পার হয়ে এপারে চলে এলো। ছাত্রদের টাকিপুর যুবকেন্দ্রে ট্রেনিং-এর জন্য এবং সামরিক বাহিনীর লোকদের হুদার ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিলাম। ওদের সাথে বরিশাল থেকে এম, এ, বেগ নামে একজন লোক এসে পৌঁছলো। যুবক, শিক্ষিত ও চটপটে। গায়ের রং কালো, সারা মুখমণ্ডলে প্রতিভা ও চাঞ্চল্যের স্বক্ষর। সে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীতে একজন দক্ষ প্যারাসুট সৈনিক ও একজন ফ্রগম্যান হিসেবে অনেক দুঃসাহসিক কাজে নিযুক্ত ছিল। এই কাজে ওর সমতুল্য বড় একটা কেউ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তনের চেরাটে' দীর্ঘ আট বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে 'মিডশীপম্যান' হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়। ওখান থেকে১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ রোমঞ্চকর জীবন ছেড়ে পালিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিলঃ 'বাংলাদেশ'।

 আরোও দুটো সাহসী ছেলেকে সাথে নিয়ে বেগ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হাসনাবাদ পৌঁছলো। বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার কুড়িগ্রাম নামক একটা গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে সংঘর্ষের এক চমকপ্রদ কাহিনী শুনালো সে। জায়গাটা স্বরূপকাঠি থানার অনেক ভেতরে। এখানে সারি সারি অনেক পেয়ারা বাগান আছে। দুটো সারির মাঝখানটা নালার মত। সেখানে যে কেউ অনায়াসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে। বেগ প্রায় একশ' ঝানু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দিনের বেলায় এই নালার মধ্যে লুকিয়ে থাকতো এবং রাতের অন্ধকারে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে হানাদারদের উপর আঘাত হানতো। সবার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কারো কারো কাছে মান্ধাতার আমলের তীর-ধনুক, বর্শা ইত্যাদী থাকতো। বেগ-এর বাহিনীর অবিরাম আক্রমণে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত পাক-হানাদারর একদিন, এক দালালের কাছে খবর পেয়ে দিনের বেলায়ই ওদের উপর আক্রমণ চালাবার জন্য অগ্রসর হলো। বেগও ঠিক সময়মত বাহকের মারফত হানাদারদের অগ্রসর হবার সংবাদ জেনে গেল এবং হাতের কাছে যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও পুরনো আমলের তীর-ধুনক পাওয়া গেল-তাই নিয়েই ওর লোকজনদের প্রধান প্রধান জায়গায় বসিয়ে দিল। একদিকে নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত বাংলার দুর্জয় মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী সৈন্য। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু প্রাচিন রোম নগরী বা অন্য কোন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যুদ্ধের মত এখানে বেজে উঠলো না কোন রণদামামা। উত্তেজনা চরমে উঠলো যখন দালালরা প্রায় ৫০ জন হানাদারকে সাথে নিয়ে এস পেয়ারা বাগানের ভেতর তল্লাশী চালাতে বললো। হানাদাররা বাগানে ঢুকে খুব সতর্কতার সাথে বাগানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। দক্ষ শিকারীর মত বেগ তার দুঃসাহসিক মুক্তিবাহিনী নিয়ে অসম্ভব রকমের চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। ওরা অপেক্ষায় ছিল কতক্ষণে শত্রুপক্ষ বন্দুকের নলের আওতায় আসবে। পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের 'মুক্তি' বলে ডাকতো। অনেক তল্লাশী চালিয়ে কোন ‘মুক্তির' খোজ না পেয়ে হানাদাররা পাকা পেয়ারায় ভর্তি একটা গাছের উপর বিশ্রাম নিতে লাগলো। আর কি! চতুর্দিক থেকে আচমকা ছুটে আসতে লাগলো বন্দুকে গুলি, তীর, বর্শা ইত্যাদি। হতভম্ব হয়ে হানাদাররা চিৎকার করতে করতে এদিক- ওদিক ছুট দিল। ঘটনাস্থলেই ২০ জন হানাদার খতম হলো। বাদবাকিগুলো জীবনের মায়ায় পেয়ারা গাছের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ওদের পলায়নের পালাটাও খুব আরামে কাটলো না। বাগানের বোলতা ও মৌমাছি ভয়ানকভাবে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতেমুখে হুল ফুটাতে লাগলো।

 পরে শুনেছি, পেয়ারা বাগানের এই পরাজয় হানাদারদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। এই বোকগুলো শেষ পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন দ্বারা সম্পূর্ণ পেয়ারা বাগান কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে করে ভবিষ্যতে ওরা নিরাপদ হতে পারে। এই ঘটনার পর বেগ তার গোপন আড্ডা দিয়ে অন্য আর একটি জায়গায় গিয়ে ‘যাদু' দেখাবার আয়োজন করছিল। ঠিক এই সময় গোলাগুলির অভাব দেখা দিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের গোপন পথ ধরে হাসনাবাদ আসতে হয়েছে। এই সময় বেগের মত একজন দক্ষ লোকের সাহায্য