পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
395

সহযোগিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। কেননা, সে নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতি ও কলাকৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে শত্রুদের উপর আঘাত হানবে। কিন্তু ওকে আমি যেতে দিলাম না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে পাঠালাম। বেগকে পেয়ে ক্যপ্টেন হুদা ওর কাঁদেও কিছুটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিল।

 বসন্তপুর ঘাঁটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব ওদের একলার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার দৃষ্টি আরও দক্ষিণে শমসেরনগরে দিকে নিবদ্ধ করলাম। হাসনাবাদ থেকে শমসেরনগরের দূরত্ব চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল। আক্রমণ পরিচালনার জন্য কৌশলগত কতকগুলো মূল অসুবিধা ছিল। প্রথমতঃ জায়গাটা আমাদের আওতা থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থা একমাত্র নদীপথ। দ্বিতীয়তঃ যদিও ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়িতে একটা বেতার ব্যবস্থা ছিল, তবুও আমাদের নিজস্ব কোন বেতারযন্ত্র না থাকায় এতদূর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তাছাড়াও নতুন আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার আগে জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নতুন করে কোন কিছু করতে যাব কিনা এ বিষয়ে নিজে নিজে ভাবছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ একদিন ভোরে ২০০ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিহার প্রদেশের চাকুলিয়া থেকে এসে হাজির হলো। এইসব যুবক মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে 'ক্রাশ প্রোগ্রামে' ট্রেনিং লাভ করে। প্রয়োজনের সময় ওদের পেয়ে খুব স্বস্তি অনুভব করলাম। সংবাদ বাহকে মাধ্যমে আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে আরও খুশি হলাম। তাতে লেখা ছিলঃ “ব্যারাকপুরে চার্লি সেক্টর থেকে এই দু'শো' মুক্তিযোদ্ধারা জন্য শীগগীরই অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাবেন।” সংবাদটা দ্বিগুণ জোরে আমার কানে বাজতে লাগলো দু'শো' রাইফেল।

 সংবাদটা পাওয়ার পরেই মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মিঃ শাজাহানকে ডেকে টাকির কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্যে স্থান নির্বাচন করতে বললাম। নিরাপত্তার খাতিরে আমি চাইনে যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অদক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে টাকিপুর যুদ্ধক্ষেত্রে এক হয়ে মিশে থাক। আমার দপ্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে মিঃ খুরশীদকে নিয়ে জীপে চাপলাম। খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলো। সে সাধারণতঃ লেঃ খুরশীদ নামেই পরিচিত। জীবনের মূল্যবান অংশটা সে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কাটিয়েছে। একথা সে আমাকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিত। মিঃ খুরশীদ খুব সরল, সৎ ও দেশপ্রেমিক। মুখে সবসময় হাসি। এই ভদ্রলোকটি বন্ধুবান্ধবের জন্য যে কোন সময় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারতো। একমুখ দাড়ি-প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী। খুরশীদকে একজন পাক্কা গোয়েন্দার মত লাগতো। জন্ম থেকেই সে আশাবাদী। ভয়ানক দুঃসময়ে ওকে আমি হাসতে দেখেছি। তার সাহচর্য পেয়ে খুব আশ্বস্ত হলাম এবং তাকে নিয়ে আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর সদর দপ্তরে রওনা হলাম। কি আর বলবো- তিনি এমন একটা জায়গায় সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন, যার নাম নিরাপত্তার (!) খাতিরে প্রকাশ করা যায় না। যা হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা পছন্দ করতেন না। কোলকাতাতেই মিঃ খুরশীদ, সুলতান আহমেদ নামে চটপটে এক ভদ্রলোককে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আলাপ পরিচয়ে বুঝতে পারলাম মিঃ সুলতান আহমেদ বেগের একজন প্রশিক্ষণ-গুরু। এই সংবাদে শুধু সাহসই পেলাম না, রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কেনা, এতে করে আমার নতুন আখড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের আরও উন্নত প্রণালীতে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ এস গেল। আর এ জন্য মিঃ সুলতানের তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্য বেগকে নির্দেশও দিলাম।

 সুলতান ও খুরশীদকে সংগে করে কর্মচঞ্চল কোলকাতার রাস্তা দিয়ে ব্যারাকপুরের দিকে ছুটলাম। চার্লি সেক্টর খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল। কেননা, এটা একটা নতুন সংস্থা। আমার ও মেজর ওসমানের সেক্টর থেকে আক্রমণ পরিচালনায় সমন্বয় সাধনের জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই সংস্থা স্থাপন করেছে। সংক্ষেপে চার্লি সেক্টরের পরিচয় হলো- এর অধিনায়ক একজন ব্রিগেডিয়ার, তাঁর অধীনে দু'জন মেজর, দুজন