পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
396

ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন কেরানী। ব্রিগেডিয়ার জানালেন যে, ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্যের জন্য তিনিই দায়ী। সব সময় তাঁর ও স্টাফেল সক্রিয় সহযোগিতা পাব বলে আশ্বাস দিলেন। দুর্যোগময় চারটি মাসের ব্যথা-বেদনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মাঝে এই প্রথমবারের মত সক্রিয় আশ্বাসের বাণী শুনলাম। এই প্রতিশ্রুতি আমাকে ভরসা দিল, সাহস যোগালো। আমর ঝিমিয়ে পড়া মনটাকে আবার আশা- আনন্দের নতুন উদ্দীপনায় সজীব করে আরও কঠিনভাবে শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানার জন্য ফিরে এলাম আমার সদর দপ্তরে হাসানাবাদে।

 এক এক দলে ছ'জন করে মোট ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে খুলনা পাঠিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, শহরের ভেতরে ও চতুর্দিকে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের বলে দিলাম, প্রাথমিক কাজ সমাধা করার পর যারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরকে আমার ঘাঁটিতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে- যাতে করে ওরা চেনা গোপন পথ ধরে পরপর গেরিলা দলকে বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে পারে। এই গিরিলা পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রথম উদ্দেশ্য হলো বিকল্প গোপন পথ খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়তঃ নির্ভরযোগ্য স্থানীয় লোকদের সহায়তায় শহরের ভেতরে ও তার চতুর্দিকে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করা। তৃতীয়তঃ পথপ্রদর্শকদের ফেরত পাঠিয়ে খবরাখবর আদান-প্রদান কর। তখনকার দিনে এই কাজগুলো সমাধা করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। কেননা, পাকিস্তানী পশুগুলোর হিংস থাবা গ্রামবাংলার সব জায়গায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। ওদের ভেতর কোন রকম অনিচ্ছা বা বিষাদের ভাব খুঁজে পেলাম না। এমন কি ওদের তীব্র চোখেমুখে দেখতে পেলাম চরম উত্তেজনা ও প্রতিহিংসার দুর্বার আগুন। ওদের এই আত্মবিশ্বাসের দুটো কারন হতে পারে। প্রথমতঃ খুলনার অধিবাসী দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানী হানাদাররা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলেও ভেতরের জনসাধারণের আওয়ামী লীগের উপর আস্থা ছিল। গেরিলাদের কাছে ছিল স্টেনগান গ্রেনেড ও চাকু। ওদের নিরাপত্তা ও পথে যদি ওরা হঠাৎ‍ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অথবা শত্রুর সামনে পড়ে তাহলে ওদের মোকাবেলা করার জন্য কিছু হালকা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্যও সাথে দিয়ে দিলাম। প্রাণঢালা আশীর্বাদ করে আগের নির্দেশানুযায়ী ওদের বিভিন্ন রাস্তায় পাঠিয়ে দিলাম।

 সময়টা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের রাত্রি। শত্রুপক্ষের সামরিক যন্ত্রটাকে স্তব্ধ করার জন্য শিল্প এলাকায় আমার দ্বিতীয় পর্বের আক্রমণ শুরু হলো। শিল্প এলাকাগুলোর কার্যক্ষমতা অচল করে দিরতে পারলে সামরিক যন্ত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখার মত হানাদারদের অর্থের অনটন ঘটবে। এই কাজটা খুবই মর্মান্তিক। কেউই চায় না তার নিজের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিসাধন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। কেননা, আমাদের সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য এ কাজটা ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করবে এবং সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষের আক্রমণধারাও পংগু করে দেবে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন হুদাও তার ঘাঁটি থেকে আক্রমণের গতি বেশ সন্তোষজনকভাবে বাড়িয়ে দিল। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ৩৫ জনের ছোট্ট বাহিনীটি বাড়তে বাড়তে ৩৩০ জনে এসে দাঁড়ালো। শত্রুপক্ষের উপর রীতিমত আক্রমণ চালিয়ে তারা বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করলো। বেগের অক্লান্ত সহযোগিতায় হুদা পাকবাহিনীর তিনটি সীমান্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। এর ভেতর ছিল দক্ষিণে উকসা, বসন্তপুরের উত্তরে দেবহাটা ও খানজী সীমান্ত ফাঁড়ি। মাইন, ডিনামাইট ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওই ফাঁড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উকসা অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারায় বেরুলে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ওদের কাবু করেছিল, সে সম্বন্ধে হুদা আমাকে একটি চমকপ্রদ কাহিনী শোনালো। ওঁৎ পেতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর আঘাত হানার জন্য জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ক্যাপ্টেন হুদা ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে ইছামতি পার হলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা উকসা ঘাঁটিতে খুব ভোরে পাহারায় বেরুতো। হুদা ও তার সাথের লোকের একটা খুঁটির সাথে 'জয় বাংলা' পতাকা লটকিয়ে তার চারিদিকে ‘এণ্টিপার সনাল’ মাইন পুঁতে রেখে নিকটবর্তী একটা ধানক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ওরা ফিস ফিস শব্দে শুনতে পেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তখনও গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু আবছা অন্ধকার। হুদা ও তার সাথের লোকজন জলভর্তি ধানক্ষেতের মধ্যে চুপচাপ প্রস্তুত হয়ে রইলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হানাদাররা