পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
397

এদিকে আসলো না। উড়ন্ত ‘জয় বাংলা' পতাকাটা চোখে পড়তেই মাথাভারী কুত্তার দল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং ওটাকে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলার জন্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ছুটে আসলো। আর যায় কোথায়? সমস্ত পৃথিবীটাকে কাঁপিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। হাতির মত পাকিস্তানী দৈত্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়লো এবং হুদা তার লোকজন ও শত্রুদের পরিত্যক্ত অস্ত্র নিয়ে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে এলো।

 আমার মনে পড়ে, ‘ভট্টাচার্য' নামক দশ বছরের একটি ছেলে বেগের বিশেষ ‘বাহিনীতে যোগ দেয়। এই বিশেষ বাহিনীটির নাম 'হার্ড কোর অব সার্জেণ্টস'। এর বিশেষত্ব ছিল বারো বছরের ঊর্দ্ধে কোন বালককে এই বাহিনীতে নেয়া হতো না। নতুন এসেও, ভট্টাচার্য কঠিন পরিশ্রমের বলে সার্জেণ্ট মেজরের পদে উন্নতী হলো। সে নিজে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। উপরন্তু, চারদিকে শত্রুথাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান, শক্তি, সাতক্ষীরা- কালিগঞ্জ রাস্তায় পারুলিয়া ব্রীজের খুঁটিনাটি সব মূল্যবান সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার ক্ষুদে বাহিনীকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করেছি। পারুলিয়া ব্রীজটা লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট। এই ব্রীজের উপর দিয়েই হানাদাররা তাদের রসদসম্ভার, অস্ত্রশস্ত্র কালিগঞ্জ ও বসন্তপুরের নিয়ে যেত। ব্রীজটার উপর হামলা চালানোর দিন ভট্টাচার্য রাতের অন্ধকারের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ব্রীজের এক প্রান্তে পাহারারত সান্ত্রীদের কয়েক গজের মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আর এদিকে বেগ ব্রীজের নিচে বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দিল। সংকেত দিতেই এই দশ বছরের সার্জেণ্ট মেজরটি ঝোপের আড়াল থেকে শত্রুর দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারলে কোনদিক থেকে গ্রেনেড ছুঁড়েছে টের পাবার আগে সান্ত্রীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারপর সার্জেণ্ট মেজরটি তার ছোট্ট কনুইয়ের উপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বেগের সাথে এসে মিলিত হলো এবং নীরব অপেক্ষা করতে লাগলো কখন বিস্ফোরণের ভয়ানক গর্জনটা কানে ভেসে আসবে। দীর্ঘমেয়াদী বিস্ফোরক দ্রব্য বুকে নিয়ে ব্রীজটা অসম্ভব সকমের নীরব ও শান্ত। মগজহীন হানাদার সান্ত্রীরা ভারী বুট পায়ে ব্রীজের অপর প্রান্তে পায়চারি করছিলো। বেগ হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় আসন্ন। উহ কি ভয়ানক উত্তেজনা। প্রচণ্ড শব্দ করে ব্রীজের বেশীর ভাগ অংশ উড়ে গেল। আর পোশাক পর পাকিস্তানী পশুগুলো চিরদিনের জন্য ভেসে গেল স্রোতের জলে।

 আমাদের উপর্যুপরি সাফল্যে একদিন যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল উন্নত হলো, অন্যদিকে অনেকগুলো অসুবিধাও দেখা দিল। কেননা, মুক্তিযোদ্ধারা ঘন ঘন আক্রমণ করায় পাক হানাদাররা ক্ষেপে গিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের লোকজনের উপর চরম অত্যাচার আরম্ভ করলো। ওদের অকথ্য অত্যাচারের ফলে স্থানীয় লোকজন আমাদের উপর কিছুটা বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। এর ফলে আমাদের গেরিলা কৌশল অনেকটা ব্যাহত হলো। বেসামরিক জনসাধারণ আমাদেরকে শত্রুমনে করতো না। কোন অঞ্চল মুক্ত হলে সেখানে আমরা অবস্থান করি, এটা তারা মনে মনে সব সময় কামনা করতো। কিন্তু নানান অসুবিধার জন্য আমরা মুক্তাঞ্চলে থাকতাম না। প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে কোন জায়গা দখলে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না, দ্বিতীয়তঃ আমাদের ছেলেরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে প্রশিক্সণ প্রাপ্ত নয়। তৃতীয়তঃ লোকসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা আমাদের চাইতে অনেক উন্নত। খণ্ডযুদ্ধ চালাবার মত শক্তি আমাদের ছিল না। সুতরাং একমাত্র কৌশল আমাদের সামনে যা খোলা ছিল, সেটা হলো সেই পুরানো কায়দা- 'আক্রমণ করো এবং পালিয়ে এসো।' এই কৌশল আবলম্বন করায় যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকের নিরীহ লোকদের জীবনে নেমে আসলো অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু আমাদের কোন বিকল্প পন্থাও ছিল না।

 শাসনকার্য পরিচালনার জন্য কিছু লোক হিংগলগঞ্জ রেখে ক্যাপ্টেন হুদা ইতিমধ্যেই তার দপ্তর উকসা নিয়ে এসেছে। উকসায় তাঁকে পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কেননা, নদীর তীর বরাবর উঁচু বাধ ছাড়া আর কোন জায়গা ছিল না, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে। বাঁধের নীচে যতদূর চোখ যায় শুধু কর্দমাক্ত ধানক্ষেত। অন্য কোন উপায় না থাকায় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মাথা গুঁজতে হতো। তাড়াতাড়িতে খোঁড়া এই ব্যূহগুলো প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা সহ্য করতে পারতো না। এই মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতো। বেশীর ভাগ সময়আধপেটাখেয়েদিন কাটাতো। কেননা, রান্নাবান্না করার অনেক অসুবিধাও ছিল। যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে হুদা ওদের মনোবল বাঁচিয়ে