পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
400

লোকদের যোগাড় করার জন্য সে একসেক্টর থেকে আর এক সেক্টরে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেরিয়েছে। ছেলেরা মানের মত কাজ পাওয়ায় ওর উপর খুব কৃতজ্ঞ হলো। আমার এই সংস্থাটি পরে 'বাংলাদেশ নৌবাহিনী' নামে পরিচিত হয়ে ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। এই বাহিনীর উপর প্রথম কাজ দেয়া হলো, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রীতিমত সরবরাহ করা। দ্বিতীয়তঃ নদীতে আক্রমণাত্বক পাহারা দেয়া। তৃতীয়তঃ নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম সুসমাধা করা। নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম বলতে বুঝায়-মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্দিষ্ট ঘাঁটিতে নামিয়ে দেয়া। তারপর কাজ সমাধা হলে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

 সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ রাত্রে যার সাথে দেখা হয়েছিল, সুন্দরবনের 'রাজা' সেই নওয়াবদী প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হাসনাবাদ থেকে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা লঞ্চে থাকার পর শমসেরনগর পৌঁছলাম। তখন রাত গাঢ় অন্ধকার। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এত অন্ধকার যে দু’গজ সামনে পর্যন্ত দেখা যায় না। চালকের পক্ষে লঞ্চ চালনা করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠলো। সার্চলাইটের আলোতে বেশীদুর দেখা যায় না। প্রমত্তা রায়মঙ্গল এর উপর ভেসে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ তীর থেকে আমাদের উপর টর্চলাইটের আলো এসে পড়লো। অনুসন্ধানে জানতে পারলাম যে, ওটা ভারতের সীমান্ত ফাঁড়ির আলো। ওই ফাঁড়ির লোকেরা সলিমুল্লাহর আস্তানায় পৌঁছতে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করলো। এই সময় বৃষ্টির মধ্যে দেখতে পেয়ে সলিমুল্লাহ আনন্দে আত্মহারা। ওখানকার সব ছেলের সাথে আমি দেখা করলাম। বৃষ্টির ঝাপটা এসে বাঁশের ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। এই বর্ষার রাত্রেই সুন্দরবনের ‘রাজা' নওয়াবদীর সাথে আমার দেখা হয়। পাক-বর্বরদের নৃশংস অত্যাচারে টিকতে না পেরে সুন্দরবনের হরিনগর গ্রামের তার পৈতৃক ভিটামাটির মায়া ত্যাগ করে ঝড়ের মধ্যেই পরিবারের সবাইকে তিনটি নৌকায় নিয়ে নওয়াবদী বেরিয়ে পড়ে। সুন্দরবনের রাজার চোখে জল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তার জীবনে এমন দুঃখের দিন কখনো আসবে এবং পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে। হারিকেনের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম তার চোখে প্রতিহিংসার আগুন। চপলমতি ছোট্ট বালকের মত হঠাৎ সেই শক্ত মানুষটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে আমাকে জানালো যে, মাত্র চারটা রাইফেল পেলে আজ রাত্রেই তার পরিবারের লোকজন নিয়ে সে গ্রামে ফিরে যাবে। তক্ষুনি তাকে চারটা রাইফেল দিয়ে দিলাম। নিকষ কালো লোকটা প্রচণ্ড উল্লাসে সাদা দাঁতগুলো বের করে দুরন্ত বাতাসের সাথে দৈত্যের মত অন্তর্হিত হলো। এর ফলে শীগগীরই সে সুন্দরবনের গভীরে আমাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রসারিত করতে নিষ্ঠার সাথে সাহায্য করেছিল।

 বেগের একটি ‘যুদ্ধবাহিনী' ছিল। তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় যে কোন ঝুঁকি নিতে তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকেতো। সংখ্যায় সব মিলিয়ে দুশো হবে। সবাই যুদ্ধ করার মত উপযুক্ত। যা কল্পনা করেছিলাম- সেই প্রস্তুতি, সেই উৎকর্ষতা ওদের মাঝে দেখতে পেয়ে আমি সুন্দরবনের গভীরে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার লোভ সামলাতে পারলাম না। সুন্দরবনটা দেখতে প্রায় ভিয়েতনামের হো চি মিন সড়কের মতো। কোন কারণে যুদ্ধ বিলম্বিত হলে, প্রাকৃতিক গুপ্তস্থানে ভরপুর এই সুন্দর বনাঞ্চল ছাড়া বাংলার আর কোন জায়গা এতটা সুবিধাজনক নয়। ব্যূহ রচনার কৌশলাদি ঠিকমত নিরূপণ করে এই অঞ্চলে যদি ঘাঁটি স্থাপন করা যায় তাহলে মুক্তিযুদ্ধ যে কোনভাবে যে কোন সময়সীমা পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনা মনে রেখে কৈখালিতে সলিমুল্লাহর জায়গায় বেগকে বসিয়ে দেয়ায় আমি তাকে শ্যামনগর থেকে নিয়ে এলাম। কাজ শুরু করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বেগকে বুড়ি গোয়ালিনী, হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপন করার দায়িত্ব দিলাম। ফ্লাইট সার্জেণ্ট সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে রাতের বেলায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে দু'জন পাকিস্তানী সৈন্য ও কয়েকজন রাজাকার খতম করে এক সপ্তাহ আগে এই ‘বুড়ি গোয়ালিনী' অধিকার করা হয়। বুড়ি গোয়ালিনীতে বন বিভাগের অফিস ও একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিলো।

 দুঃসাহসিক কাজের জন্য সলিমুল্লাহকে সম্মানসূচক লেফটেন্যাণ্ট পদে উন্নীত করা হয়। এই বুড়ি গোয়ালিনী অধিকার করা আমাদের পক্ষে একটা বিরাট সফলতা। কেননা, এখান থেকেই পাক সৈন্যরা সুন্দরবনের ভেতরে ও অগ্রভাগে আমাদের চলাচলের উপর নজর রাখতো এবং খবর সংগ্রহ করতো। উল্লেখ করা যেতে পারে যে,