পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
401

এই ট্রান্সমিটারটাই আমার যাত্রার উদ্দেশ্যটা ব্যর্থতার পর্যবসিত করেছিল। সলিমুল্লার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেগ ও তার বাহিনী শত্রুপক্ষের হামলা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। গানবোটগুলির উপর আঘাত করার জন্য বেগ সবসময় ওঁৎ পেতে প্রস্ত্তত হয়ে থাকতো। বুড়ি গোয়ালিনি পতনের পর পাক হানাদাররা মাঝে মাঝে আমাদের ঘাঁটির নিম্নাঞ্চল গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরুতো। অক্লান্ত পরিশ্রম করে ও উপর্যুপরি কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী বিতাড়িত করে বেগ সেখানে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করলো। এইসব ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত হবার পর পাক হানাদাররা সহসা পাল্টা আক্রমণ করতো না। কোন কারণে তারা যেন নরম হয়ে গেল। আমরা কখনও আক্রমণ করলে হানাদাররা খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠতো। বোধ হয় ওদের ভয় ধরেছিল যে, আমরা ওদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছি। কেননা একদিকে সুন্দরবনের উপরিভাগ থেকে বেগ ও তার দুঃসাহসী যোদ্ধারা শত্রুদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ চালাচ্ছিল, আর অন্যদিকে দক্ষিণ শরণখোলা থেকে কঠিন আঘাত হানছিল ক্যাপ্টেন জিয়া।

 মাত্র সীমান্ত পরিধির ভেতর সীমাবদ্ধ এই যুদ্ধে আমি খুশী ছিলাম না। কেননা, সীমান্ত এলাকা থেকে মাত্র কয়েক মাইল জুড়ে আমাদের মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সার্বিক বিজয় অর্জন করতে আমাদের বহু বছর লাগতে পারে। কারন ওরা বৃত্তাকারে সুদৃঢ় ব্যূহ রচনা করে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করছে এবং যতই সময় যাচ্ছে, ওরা নিজেদের অবস্থার খুবই মজবুত করে নিচ্ছে। যদিও পাকিস্তানী হানাদাররা বৃত্তাকার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তবুও তারা মানসিক দিক দিয়ে একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। তৎসত্ত্বেও ওদের উপর বড় রকমের আঘাত হানার মত অবস্থান আমাদের ছিল না। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি সম্বন্ধেও খুব বেশী পারদর্শী নয়। তাড়াতাড়িতে যেটুকু প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, তাতে কোন কোন খণ্ডযুদ্ধে সবাইকে একত্রে জড় হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। এটা আমাদের পক্ষে আত্মঘাতী স্বরুপ। যখনই আমাদের বড় রকমের একটা বিপর্যয় এসেছে, তখনই দেখা গেছে যে, এটা ওদের একত্রে জড় হবার চিরাচরিত অভ্যাসের পরিণত। যা হোক, সময়ে যুদ্ধ করে সফলতা আমরা অর্জন করেছি, তা থেকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যুদ্ধকৌশল নয়-আক্রমণের গতিধারা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সফলতা আসবেই।

 এই রুপরেখাটা মনে রেখে বিশদভাবে পরিকল্পনা তৈরী করলাম যে, দেশের প্রতি আনাচে-কানাচে মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়িয়ে দিতে হবে ও আক্রমণের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে প্রতি থানায়। থানা থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে ঘরে ঘরে যেন শত্রুরা পিছনে দেখতে আজরাইল' ওদের সামনে। যে হারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আমার নতুন ক্যাম্প 'বাকুনদিয়া' এসে জড় হচ্ছিল, তাতে ওদের জন্য যদি প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা যায়, তাহলে এই পরিকল্পনার রূপায়ণ মোটেই কষ্টকর নয়। বাকুদিয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যস্ততম ও বৃহত্তম পাদপীঠ- যেখানে মুক্তিগামী মানুষের এই মৃত্যুঞ্জয়ী কাফেলা প্রবল প্রাণোদ্দামে ভরপুর হয়ে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে উল্কার মতো ছুটে গিয়েছিল ঐ মানুষখেকো বাঘ ও হিংস্র জন্তুর অবাধ লীলাক্ষেত্র সুন্দরবনের গভীর অভ্যন্তরে এবং বাংলার মাঠে-ঘাটে, প্রতিটি গ্রামে ও গঞ্জে।

গেরিলা অভিযান

 ৯ নং সেক্টর আমার অধীনে সর্বসাকুল্যে তিনখানা জীপ, একটি বাস ও একটি ট্রাক ছিল। এর ভেতরে মেজর ওসমানের কাছ থেকে নেয়া টয়োটা জীপটাও আছে। আমি ভাগ্যবান যে, গেরিলা পদ্ধতি প্রবর্তনের সময় এই যানবাহনগুলো পেয়েছিলাম। গাড়ী ও ট্রাকগুলো বৃষ্টির মধ্যে অনেক সময় চলতে পারতো না। এই গাড়িগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। কোননা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এই গাড়ীগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে এর কোন রক্ষণাবেক্ষণই হয়নি। অবশ্য শেষের দিকে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কোন এক সময়ে ব্যারাকপুরের চার্লি সেক্টর পশ্চিম রণাঙ্গনের 'জয়বাংলা' গাড়ীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়।