পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
402

এ কাহিনীর একটা দিক মাত্র। নৌকায় খালবিল দিয়ে গেরিলা পাঠানোর চেয়ে স্থলপথে পাঠানোর অনেকটা কম সমস্যা- সংকুল। স্থলপথে যারা যাবে তাদের শুধু রেশনের টাকা দিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু যারা জলপথে যাবে, তাদের জন্য চাই পথঘাট ভাল চেনে এইরকম উপযুক্ত মাঝি। এইমসয় ওই রকম মাঝি যোগাড় কারা খুবই দুষ্কর ছিল। ভাগ্য ভাল, এ ব্যাপারে আদম সন্তান পাচার করে এই রকম একজন চোরাচালানীর সাক্ষাত পেয়ে গেলাম। সারাজীবন সুন্দর বনের খাল বিল দিয়ে সে চোরাকারবার করেছে। সুতরাং মানচিত্রের চাইতেও সুন্দরবনের গোপন পথঘাটের খবর তার কাছে সঠিকভাবে পাওয়া যেত। সে প্রাণ দিয়ে কাজ করছে এবং কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে পথ দেখিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীতে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছে। তার নাম রইজুদ্দিন। এক সময়ের কোটিপতি। আজ তার সর্বস্ব পাকহানাদাররা কেড়ে নিয়েছে। বয়স পঞ্চাশের মাঝামাঝি, পতলা, কালো। এই রইজুদ্দিন ভয়ানক ধূর্ত ও চটপটে একদিন সে গর্ব করে বললো, “স্যার, হানাদারদের বাপের সাধ্য নেই আমাকে ধরে। কোননা, এই দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ওদের চোখে ধুলো দিয়ে 'কাম' করে আসছি। কিন্তু খোদাকে বিশ্বাস করি। তিনি নারাজ হলে যে কোন মুহূর্তে আমি ধরা পড়তে পারি।

 জুলাই মাসে ৬০ জন লোকের একদল মুক্তিযোদ্ধা খুলনার উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিল। আরও দল, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার পথপ্রদর্শকদের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ফেরত পাঠিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ওরা মাত্র চারজন ফিরে এসে খবর দিল যে, রাজাকারদের জন্য খুলনায় থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। মুসলিম লীগের পাণ্ডরা বাঙ্গালীদের দিয়ে এই রাজাকার বাহিনী গঠন করেছে। জুন মাস থেকেই রাজাকার বাহিনীতে লোক ভর্তি বেড়ে যায়। কেননা, ওই সময়ে বেশীভাগ জোয়ান ছেলেরা প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে আসে। তখন থেকে আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটা থমথমে ভাব। এই সময়ে রাজাকারদের ঘৃণ্য সহযোগিতায় পাক-বর্বররা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্রা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। এর উপর এই সময়ে বিহারী মুসলমানদের নিয়ে গঠিত আর একটা বাহিনী দেশব্যাপী লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলো। এমনকি, ওদের প্রভুদের পশুপ্রবৃত্তিকে খুশি করার জন্য এই পা-চাটা কুকুরের দল নারী হরণ পর্যন্ত করতে এতটুকু সংকোচ বা দ্বিধা করলো না। এইসব হৃদয়বিদারক খবর শুনে আমরা যে কিরূপ মর্মাহত হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে প্রতিহিংসার অনির্বাণ শিখা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। সারা জুলাই মাস ধরে পুরো বর্ষা। দপ্তরে দপ্তরে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, অধিনায়ক এখনই এই মুহূতে শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। সবাই যুদ্ধংদেহী চিৎকারে ফেটে পড়লো। বর্ষাকালেই শত্রুর বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলে বাংলার পবিত্র মাটিতে যুদ্ধ করার চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। মোট কথা জুলাই, আগস্ট- এই দু'মাস মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ উভয়ের কাছেই ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে জরুরী কাজ হলো- বৃত্তাকার যুদ্ধে, শক্তি কেন্দ্রীভূত না করে বেশী সংখ্যায় দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে রাজাকার ও অন্যান্য গজিয়ে ওঠা সহায্যকারী সংগঠনগুলোর প্রসার এখনই স্তব্ধ করে দেয়া। আমাদের সর্বাধিনায়ক যে পরিকল্পনা তৈরী করেছিলন, তাতেও এই গেরিলা বাহিনী প্রবর্তনের উপর বেশী জোর দেয়া হয়েছিল। তাই আমিও গেরিলা বাহিনী প্রবর্তনের জন্য একটা বিশদ পরিকল্পনা তৈরী করলাম। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী এই চারটি জেলাকে ১৯ টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হলো। আগের কার্যক্রম অনুযায়ী এক একটি অঞ্চলে দু' একটি থেকে তিনটি থানা থাকবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আগে হতেই যেসব গেরিলা ঘাঁটি ছিল-তা সর্বমোট ৮৩টি। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি থানার দায়িত্ব যথাক্রমে একজন সামরিক অফিসার, একজন জুনিয়ার কমিশন অফিসার, অথবা অভিজ্ঞ নন-কমিশন অফিসার এবং বাছাই করা একজন ছাত্রের উপর ন্যস্ত থাকবে। সকল পর্যায়ে এদের সাথে থাকবে একজন করে সহ- অধিনায়ক।

 আরও স্থির করলাম যে, উপরের সংখ্যানুযায়ী একই অনুপাতে রাজনৈতিক নেতারাও তাদের সহকারীদের নিয়ে এ ঘাঁটিতে থাকবেন-যেন গেরিলারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় কার্যকরীভাবে আক্রমণের