পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
404

কেউ গোলাবারুদ, কেউ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যেত। সেপ্টেম্বর মাসে অবস্থার পরিবর্তন হল। তখন থেকেই সবাই হাতে অস্ত্র পেল। তাছাড়াও রাজাকার, পুলিশ ও পাক হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্রপাতি দিয়ে বেশী সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধা ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। এমন একটা সময় এলো যখন আমার সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাড়ালো প্রায় বিশ হাজার। মুক্তাঞ্চলে স্থানীয় অধিনায়কেরা প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আরো বাড়তে লাগলো। আমার মতে, এতে ছেলেদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হতো। কেননা, বিপদসংকুল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ভারতে আসার কষ্ট থেকে ওরা বেঁচে যেত। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও সফলতার পরিমাণ আশানুরুপভাবে বৃদ্ধি পায়নি। সময়ে সময়ে বাহকের মারফৎ যেসব খবর পেতাম, তা থেকে এটা পরিস্কার হয়ে উঠলো যে, মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানতঃ রাজাকার ও পুলিশদের উপর আক্রমণ চালিয়ে সফলতা অর্জন করছে-পাক সৈন্যর বিরুদ্ধে খুব কমসংখ্যক আক্রমণই পরিচালিত হতো। এর কারন, গেরিলারা যে পাক-হানাদারদের ভয় করত তা নয়। অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে ওরা শুধু আক্রমণ করে শত্রুকে কিভাবে খতম করতে হয়, তাই শিখেছিল। আক্রমণ করে কিভাবে পলায়ন করতে হয়, সে কৌশল ওদের ভাল করে জানা ছিল না। যদিও গেরিলা যুদ্ধের নীতি- “আঘাত করো ও পালিয়ে যাও' এ সম্বন্ধে তাদের একটা মোটামুটি ধারনাও ছিল, তবুও আমার কাছে মনে হল, ওরা যেন কম আঘাত করে বেশী করে পালিয়ে আসতো। আমার এ ধারনা অনেকাংশে সত্যি। তা না হলে যদি গেরিলারা নির্দেশ মোতাবেক তাদের দায়িত্ব পুরাপুরি পালন করতো, তাহলে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সেক্টর থেকে যে পরিমাণ গেরিলা ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাতে পাক সামরিক যন্ত্রটাকে মাত্র দ’মাসের ভেতরেই বিকল করে দেওয়া সম্ভব হতো।

 খুলনা জেলার তেরখাদা, মোল্লারহাট, মোড়লগঞ্জ, বাগেরহাট, সুন্দরবন, পাইকগাছা এবং ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশাল শত্রুপক্ষের সাথে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে উত্তেজনায় সর্বদা উত্তপ্ত থাকতো। বস্তুতপক্ষে গতিশীল নেতৃত্বের জন্যই উপরোক্ত জায়গা গুলি মুক্তিসংগ্রামে ভাল অবদান রাখতে পেরেছিল। দেশের ভিতরের এতসব ঘটনার কথা আমাদের কাছে পৌঁছতো না। কারন বাহকের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদান করা ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অনেক বাহক আমাদের সদর দফতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারতো না। পথেই কঠিন মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়তো। যখন দেশের আনাচে-কানাচে হানাদারেরা জাল পেতে বসে আছে, তখন বাহকের কাজটা খুব আরামদায়ক নয়। বর্ষাকালে রাত্রের অন্ধকারে বুক পরিমাণ জলের ভিতর দিয়ে হেঁটে সংবাদ নিয়ে আসাটা কতটা কষ্টসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়। মনে পড়ছে পনের বছর বয়স্ক পাতলা গড়ন প্রবেশিকা পরিক্ষার্থী আলমের কাছ থেকে শোনা একটা লোমহর্ষক কাহিনীর কথা। বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের ছেলে আলম। শত শত গেরিলাকে পথ দেখিয়ে সে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বরিশাল থেকে সুদূর পশ্চিম বঙ্গ পর্যন্ত সংবাদ নিয়ে ফিরে আসে। একজন পথপ্রদর্শক ও সংবাদ বাহক হিসাবে আলম নিজেকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রমানিত করেছিল। দেখতে খুবই বেমানান এই ছেলেটি, জলন্ত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শত শত গেরিলাকে শুধু পথ দেখিয়েই ভিতরে নিয়ে যায়নি, ভিতর থেকে শত শত অদক্ষ যুবককে ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য নিয়ে এসেছে। এই ছেলেটি চতুর ও বুদ্ধিদীপ্ত। অনেকবার সে পাক হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছে। তার চেহারার ভিতর একটা সরল মাধুর্য আছে। সে এত ভাল উর্দু বলতে পারতো যে, মাথাভারী দেহসর্বস্ব পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে বিহারী মুসলমান বলে ভুল করে ছেড়ে দিয়েছে। জুলাই মাসে সীমান্তবর্তী বাগদা থেকে আলমই সর্বপ্রথম গেরিলাদের বরিশাল ও ফরিদপুর নিয়ে আসে।

জুলাই ও আগষ্ট মাসের সেই বর্ষণমুখর রাতগুলোর কথা আজো আমার মনে পড়ছে। প্রতি রাত্রে বর্ষা মাথায় করে বাংলার অতন্দ্র প্রহরী এই গেরিলারা বাগদার সীমান্ত অতিক্রম করে ভিতরে চলে যেত। প্রমত্তা ইছামতি ছুটে চলেছে। দ'কুল তার বহু দুর পর্যন্ত প্লাবিত। এরই ভিতর কত রাত দেখেছি বাংলার এই অগ্নিসন্তান গেরিলারা ভয়কে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোন রকম ওজর আপত্তি না করে অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে পানি কাদার মধ্যে শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে। শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। রাইফেলটায় যাতে পানির স্পর্শ না লাগে, সে জন্য ওটাকে উপর দিকে তুলে ধরতো। কি অভূতপুর্ব দেশপ্রেম।